নয়ন বন্ড ও রিফাত ফরাজী ঢাকায় যাঁদের আশ্রয়ে ছিলেন

রিফাত শরীফকে প্রকাশ্যে কোপানোর পর ঢাকায় পালিয়ে এসেছিলেন প্রধান অভিযুক্ত সাব্বির আহমেদ ওরফে নয়ন বন্ড এবং রিফাত ফরাজী। তাঁরা উঠেছিলেন আফতাবনগরে তাঁর এক বন্ধুর কাছে। ২৭ জুন মধ্যরাতে সেখান থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর নয়নের আর কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিল না। এর ৩ দিন পর ২ জুলাই নয়নের লাশ পাওয়া যায় বরগুনা সদরের বুড়িরচর ইউনিয়নের পূর্ব বুড়িরচর গ্রামে।

পুলিশ জানায়, নয়নকে গ্রেপ্তার করতে ওই এলাকায় গেলে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ তিনি ঘটনাস্থলেই নিহত হন।

গত ২৬ জুন রিফাত শরীফকে বরগুনা সরকারি কলেজের মূল ফটকের কাছে তাঁর স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকার সামনে নৃশংসভাবে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। পরদিন রিফাতের বাবা বরগুনা সদর থানায় সাব্বির আহমেদ ওরফে নয়ন বন্ড, রিফাত ফরাজীসহ ১২ জনকে আসামি করে হত্যা মামলা করেন। ‘বন্দুকযুদ্ধে’ সাব্বির নিহত হওয়ার পর ওই দিন রাত আড়াইটায় বরগুনা থেকে রিফাত ফরাজীকে গ্রেপ্তারের কথা জানায় পুলিশ। তবে ৩ জুলাই নিজ কার্যালয়ে রিফাতের গ্রেপ্তারের বিষয়ে করা সংবাদ সম্মেলনে বরগুনা পুলিশ সুপার মো. মারুফ হোসেন তাঁকে কোথা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তা উল্লেখ করেননি। ‘তদন্তের স্বার্থে’ গ্রেপ্তারের স্থান উল্লেখ করা যাবে না বলে জানান তিনি।

রিফাত শরীফকে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যার ঘটনায় পুলিশ এখন পর্যন্ত ১১ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। এর মধ্যে ৬ জন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।

প্রথম আলোর অনুসন্ধানে রিফাতকে কুপিয়ে হত্যার পর ২৭ জুন রাতে রাজধানী ঢাকার আফতাবনগরে সাব্বির আহমেদ ওরফে নয়ন বন্ড ও রিফাত ফরাজীর উপস্থিতি নিশ্চিত হওয়া গেছে।

নয়ন বন্ড ও রিফাত ফরাজী
নয়ন বন্ড ও রিফাত ফরাজী

আফতাবনগরের ডি ব্লকের আলিফ স্টিল নামক একটি শাটার ও গ্রিল তৈরির ওয়ার্কশপে কাজ করতেন সাব্বিরের বন্ধু সৈকত ও তাঁর ভাই শান্ত। তাঁদের বাড়ি বরগুনার বেতাগীর ৯ নম্বর কাজিরাবাদ ইউনিয়নে। ওয়ার্কশপের মালিক শফিক তাঁদের ভগ্নিপতি। তাঁর বাড়িও বরগুনায়। রিফাতকে কুপিয়ে হত্যার পরদিন রাতে এই ওয়ার্কশপে এসে উঠেছিলেন নয়ন ও রিফাত ফরাজী। গত শনিবার ওই ওয়ার্কশপে গিয়ে সৈকত ও শান্তকে পাওয়া যায়নি। ওয়ার্কশপের কর্মচারীদেরকে নয়ন ও রিফাতের ছবি দেখালে তাঁরা জানান, ২৭ জুন রাত ১০টার দিকে এই দুজন ওয়ার্কশপে আসেন। তাঁরা রাতের খাবার খান। রাত সাড়ে ১২টার দিকে নয়ন ও রিফাতকে নিয়ে সৈকত বেরিয়ে যান।

আবুল হোসেন নামে এক কর্মচারী বলেন, তিনজন বেরিয়ে যাওয়ার ৩০ থেকে ৪০ মিনিট পর সৈকত দৌড়ে আসেন। তাঁর শরীর ভেজা ছিল। সৈকত তাঁদের জানান, পুলিশ তাঁদের ধাওয়া করেছিল। এরপর সৈকত কাপড়চোপড় বদলান এবং তাঁর ভাই শান্তকে নিয়ে ওয়ার্কশপ থেকে বেরিয়ে যান। এরপর থেকে এই দুই ভাইয়ের আর কোনো খবর তাঁরা জানেন না।

শান্ত ও সৈকতের বাবা খবির উদ্দিন হাওলাদার বরগুনার বেতাগী উপজেলার কাজিরাবাদ ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান। তিনি গত রোববার প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর ছেলে শান্ত যখন বরগুনা জেলা স্কুলে পড়ত, তখন নয়নের সঙ্গে পরিচয় হয়। বন্ধুত্বের সূত্র ধরে নয়ন ও রিফাত ঢাকায় তাঁদের কাছে গিয়েছিলেন।

রাকিব নামে আরেক কর্মচারী জানান, শান্ত ও সৈকত বেরিয়ে যাওয়ার পর রাত তিনটা থেকে সাড়ে তিনটার দিকে দুটি হায়েস গাড়িতে করে ‘ডিবি পুলিশের’ জ্যাকেট পরা কিছু লোক তাঁদের ওয়ার্কশপে আসেন। তাঁরা ওয়ার্কশপের গেট ভেঙে ফেলেন। রাকিব বলেন, তখন তাঁরা ঘুমিয়ে ছিলেন। ওই ব্যক্তিরা তাঁদের কাছে নয়ন ও রিফাতের বিষয়ে জানতে চান। তখন তাঁরা ওই ব্যক্তিদের জানান, শান্ত, সৈকত, রিফাত ও নয়ন এখান থেকে চলে গেছেন।

কর্মচারী আবুল হোসেন জানান, ডিবি পুলিশ পরিচয়ধারী ওই ব্যক্তিরা চলে যাওয়ার পর রিফাত ফরাজী আবারও ওয়ার্কশপে এসেছিলেন। তিনি রাতে সেখানে থাকতে চান, কিন্তু তাঁরা আর থাকতে দেননি। এরপর রিফাতও চলে যান।

আফতাবনগরে রাতের বেলায় প্রহরীর কাজ করেন শামীম। ‘ডিবি পুলিশ’ পরিচয়ধারী ওই ব্যক্তিরা যখন গাড়িতে করে আফতাবনগরে অবস্থান করছিলেন, তখন তিনি গাড়ি দুটি থামিয়েছিলেন। শামীম প্রথম আলোকে বলেন, হায়েস দুটির একটি সাদা রঙের এবং অন্যটি ‘পাতা রঙের’ ছিল। দুটি গাড়িরই কাচ কালো ছিল। প্রতিটিতে সাত থেকে আটজন করে ছিলেন। তাঁদের গায়ে ‘ডিবি’লেখা জ্যাকেট ছিল। তাঁরাও নিজেদের ডিবি পুলিশ বলে পরিচয় দিয়েছিলেন। শামীম বলেন, গাড়ি দুটি এরপর ওয়ার্কশপের দিকে চলে যায়।

আফতাবনগর এলাকায় ডিবি পুলিশের উপস্থিতি এবং ‘বন্দুকযুদ্ধের’ আগে সাব্বির আহমেদ ওরফে নয়ন বন্ডের নিখোঁজের বিষয়ে জানতে চাইলে ডিবি পুলিশের প্রধান অতিরিক্ত কমিশনার আবদুল বাতেন প্রথম আলোকে বলেন, নয়ন নিখোঁজ হওয়ার পর সারা দেশেই তাঁকে গ্রেপ্তারের জন্য পুলিশকে সতর্ক করা হয়েছিল। তবে আফতাবনগরে তাঁদের কোনো দল অভিযান চালিয়েছে বলে তাঁর জানা নেই।