নিজের প্রস্রাব খেয়ে জীবন বাঁচিয়ে রাখেন তিনি

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

সফিকুল ইসলামদের স্পিডবোটটা সাগরে ভাসছিল। কিন্তু সঙ্গে নেওয়া খাবার ও পানি—দুটিই শেষ। খাবারের কষ্ট নিয়ে রীতিমতো মারামারি শুরু হয়ে যায়। পানির কষ্টের কারণে সবাই নিজেদের প্রস্রাব বোতলে ধরে রাখতে শুরু করেন। সেই প্রস্রাব খেয়ে জীবন বাঁচিয়ে রাখেন।

চাঁদপুরের মতলব উত্তর উপজেলার এখলাসপুর এলাকার বাসিন্দা সফিকুল ইসলাম (৩৩)। সম্প্রতি তিউনিসিয়া থেকে ফেরত আসা ১৭ বাংলাদেশির একজন তিনি। গত ২৫ জুন তাঁর বাড়িতে গিয়ে কথা হয়।

দশম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেন সাইফুল। কিন্তু এসএসসি পরীক্ষা না দিয়েই ২০০২ সালে তিনি ঢাকায় চলে যান। সেখানে তাঁর বড় ভাইয়ের অধীনে ইলেকট্রিক কাজ শেখেন। এরপর লেগে যান কাজে। কয়েক বছর ঢাকাতে থেকেই কাজ করেন। বিয়ে করার পর ২০১১ সালে পরিদর্শন ভিসা নিয়ে দুবাইয়ে যান। সেখানে তিনি মাসে আয় করতেন ৫০ হাজার টাকার মতো। আয়ের বেশির ভাগই বাড়িতে স্ত্রী-সন্তানের কাছে পাঠিয়ে দিতেন। কিন্তু সেখানে ভিসা জটিলতার কারণে দুবাইয়ে বেশি দিন থাকতে পারেননি সফিকুল। চার বছর পর চলে আসেন দেশে।

দেশে আসার ১১ মাসের মাথায় ‘ফ্রি ভিসা’য় কাতারে যান সফিকুল। সেখানে ১৭ মাস অবস্থান করেন। কাতারে অবস্থানকালে সফিকুলকে লিবিয়া হয়ে ইউরোপ যাওয়ার পথ দেখান শরীয়তপুরের বাবলু নামের এক ব্যক্তি। ঢাকার মতিঝিলে বাবলুর ট্রাভেল এজেন্সির কার্যালয় রয়েছে। ইউরোপে যাওয়ার স্বপ্নে বিভোর সফিকুল কাতার থেকে দেশে ফিরে আসেন। বাবলুর সঙ্গে ৪ লাখ ৮০ হাজার টাকায় চুক্তিবদ্ধ হন। ওই টাকা নিয়ে সফিকুলকে লিবিয়ায় পাঠান বাবলু। তবে সরাসরি লিবিয়ায় নয়। প্রথমে উড়োজাহাজে করে প্রথমে দুবাইয়ে যেতে হয় সফিকুলকে। সেখান থেকে তিউনিসিয়া হয়ে লিবিয়ায় পৌঁছান।

সফিকুল বলেন, তিনি প্রায় এক বছর লিবিয়ায় ছিলেন। সেখানে বাসাবাড়ি ও অফিস-আদালতে ইলেকট্রিকের কাজ করতেন। ওই সময়ে মাদারীপুরের রাসেল মীর নামের এক দালালের সঙ্গে পরিচয় হয়। রাসেল তাঁকে বলেন, ১৫ ঘণ্টায় সাগরপথে ইতালিতে পৌঁছে দেবেন। এ জন্য লাগবে তিন লাখ টাকা। সাগরযাত্রার আগেই রাসেলকে তিন লাখ টাকা দিয়ে দিতে হয়।

>চাঁদপুরের মতলব উত্তর উপজেলার বাসিন্দা সফিকুল
তিউনিসিয়া থেকে ফেরত আসা বাংলাদেশির একজন সফিকুল সফিকুল
লিবিয়া হয়ে ইউরোপ যেতে চেয়েছিলেন
একপর্যায়ে সাগরে সফিকুলসহ অন্যরা মৃত্যুর মুখে পড়েন


ইউরোপে যাওয়ার জন্য সফিকুলদের দলটিতে বাংলাদেশি ছিলেন মোট ৬৪ জন। প্রায় তিন মাস দলটিকে একটি ঘরে বসিয়ে রাখেন দালাল রাসেল। বলেন, যখন জাহাজ ইউরোপ যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হবে, তখনই তাঁদের পাঠানো হবে। তিন মাস পর ওই ৬৪ জনকে জাহাজের পরিবর্তে ইঞ্জিনচালিত একটি নৌকায় (স্পিডবোট) তুলে দেন রাসেল।

সময়টা রমজান মাসের মাঝামাঝি। এক রাতে নৌকায় চড়ে রওনা হন স্বপ্নের ইউরোপের পথে। প্রায় ১৭ ঘণ্টা একটানা চলার পর নৌকাটির তলা ফেটে যায়। একপর্যায়ে নৌকার তেলও শেষ হয়ে যায়। তখন দিগ্ভ্রান্ত হয়ে সেটি ভাসতে থাকে। হঠাৎ ঝড় ওঠায় সাগরে প্রচণ্ড ঢেউ শুরু হয়। সফিকুলরা সবাই একরকম মৃত্যুর মুখে পড়েন।

সফিকুল বলেন, এভাবে দুদিন চলে যায়। নৌকায় খাবার ও পানি—দুটিই শেষ হয়ে যায়। সাগরের পানি অত্যন্ত নোনা। সঙ্গে পেট্রলের উৎকট গন্ধ। উপায়ান্তর না দেখে কেউ কেউ সাগরের পানি পান করেন। কিন্তু ওই পানি পেটে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জ্বালাপোড়া শুরু হয়ে যেত। ফলে তাঁরা সবাই একে অপরের প্রস্রাব ধরে রেখে খাওয়া শুরু করেন। শেষ পর্যন্ত তিনিও (সফিকুল) একটি বোতলে নিজের প্রস্রাব ধরে রাখেন। ওই প্রস্রাব খেয়েই কোনোমতে জীবন বাঁচিয়ে রাখেন। খাবারের কষ্ট নিয়ে অনেকে রীতিমতো মারামারি শুরু করে দেন।

চার দিনের মাথায় সফিকুলদের নৌকা থেকে প্রথমে মরক্কোর এক নাগরিক লাফিয়ে পড়েন সাগরে। তাঁকে ওই জাহাজে তুলে নেওয়া হয়। সেটা দেখে অন্যরাও সাগরে লাফিয়ে পড়তে শুরু করেন। এ অবস্থায় সবাইকে তখন ওই জাহাজে তোলা হয়। জাহাজে ২২ দিন অবস্থান করেন। ওই জাহাজেই তাঁদের আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইএমও) এবং রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির পক্ষ থেকে খাদ্য ও চিকিৎসা দেওয়া হয়। ২২ দিন পর জাহাজটি তিউনিসিয়ার বন্দরে ভেড়ে।