মাদক মামলায় দায়সারা অভিযোগপত্র

প্রথম আলো ফাইল ছবি
প্রথম আলো ফাইল ছবি

জিগাতলার ল্যাবরেটরিতে আইস, ক্রিস্টাল মেথ ও এমডিএমএ তৈরির কাঁচামালের উৎস ও বিস্তারের কোনো তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা না করেই মামলার অভিযোগপত্র দিয়েছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। ফলে ওই ল্যাবরেটরির মালিক হাসিব মো. মুয়াম্মার রশিদ কার কাছ থেকে কীভাবে মাদক তৈরির কাঁচামাল এনেছিলেন এবং কাদের কাছে বিক্রি করছিলেন তা অজানা থেকে গেল। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে দায়ের হওয়া ওই মামলার বিচার শুরু হয়েছে ৪ জুলাই থেকে।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর গত ২৭ ফেব্রুয়ারি জিগাতলার ছয়তলা ভবনের ভূগর্ভস্থ তলা থেকে আইস, ক্রিস্টাল মেথ ও এমডিএমএ তৈরির গবেষণাগারের সন্ধান পায়। এ ঘটনায় হাজারীবাগ থানায় মামলা হয়। তিন মাস তদন্তের পর মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর আদালতে যে অভিযোগপত্র জমা দেয়, তাতে মাদক তৈরির উপকরণ কার কাছ থেকে কীভাবে এনেছেন, তার ক্রেতা কারা ছিল সেসবের কোনো উল্লেখ করেনি। অভিযোগ আছে, মূল সহযোগীদের আড়াল করতে যে ভবনের ভূগর্ভস্থ তলায় হাসিব তাঁর গবেষণাগার গড়ে তুলেছিলেন, সেটির তত্ত্বাবধায়ক জাহাঙ্গীর আলমকে অধিদপ্তর ফাঁসিয়ে দিয়েছে।

অধিদপ্তরের প্রধান রাসায়নিক পরীক্ষক দুলাল কৃষ্ণ সাহা বলেন, আইস ও ইয়াবার মূল উপকরণ মিথাইল অ্যামফিটামিন। আইসে মিথাইল অ্যামফিটামিন থাকে শতভাগ, ইয়াবায় চার ভাগের এক ভাগ।

৪ জুলাই মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ৫০ গ্রাম আইসসহ নাইজেরীয় নাগরিক আজাহ অ্যানাওচুকওয়া ওনিয়ানুসিকে গ্রেপ্তার করে। পরে তাঁর কথার সূত্র ধরে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় তাঁর বাসা থেকে আরও ৪৭২ গ্রাম আইস জব্দ করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদে তিনি জানান, উগান্ডা থেকে কুরিয়ার সার্ভিসে করে আইস আনিয়েছেন তিনি। বাংলাদেশে আইসের বাজার তৈরিতে আফ্রিকার বেশ কিছু দেশ তৎপর রয়েছে।

আড়াল করা হলো অন্যদের

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের তদন্ত কর্মকর্তা মো. কামরুজ্জামানের কাছে দেওয়া জবানবন্দিতে হাসিব মো. মুয়াম্মার রশিদ বলেন, ২০১১ সালে তিনি মাদকাসক্ত হয়ে পড়েন। সে সময় তিনি অনলাইনে বিদেশ থেকে মাদক এনে ব্যবহার করতেন। গ্রেপ্তারের দুই–তিন মাস আগে তিনি অ্যামফিটামিন তৈরির বিভিন্ন উপকরণ সংগ্রহ করেন। ওই অ্যামফিটামিন তিনি নিজে ব্যবহার করতেন। বিক্রির কোনো উদ্দেশ্য ছিল না।

এই মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা অভিযোগপত্রে উল্লেখ করেন, তিনি হাসিব মো. মুয়াম্মার রশিদকে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করেন। প্রকাশ্যে ও গোপনে নানা খোঁজখবর করেন। তারপরই তিনি হাসিবের বিরুদ্ধে মাদক সরবরাহ, কেনাবেচা, দখল, সংরক্ষণ, গুদামজাতকরণ ও প্রদর্শনের অভিযোগ আনেন। কিন্তু হাসিব জবানবন্দিতে বিদেশ থেকে মাদকের উপকরণ আনার কথা বললেও, কোন দেশ থেকে কীভাবে এনেছেন, তাঁর সহযোগী কারা ছিল, তা অভিযোগপত্রে উল্লেখ করেননি তদন্তকারী কর্মকর্তা।

>

জিগাতলায় আইস তৈরির কারখানা
আইসকে বাংলাদেশের জন্য ভয়াবহ হুমকি হিসেবে ধরা হচ্ছে
আইস তৈরির কাঁচামাল কোথা থেকে এল জানে না অধিদপ্তর

জিগাতলার যে ছয়তলা ভবনের ভূগর্ভস্থ তলায় হাসিব মো. মুয়াম্মার রশিদ ল্যাবটি গড়ে তুলেছিলেন, সেই ভবনটির মালিক তাঁর বাবা এফ এম রাশিদুজ্জামান। ওই বাড়িটিও তাঁদের নিজেদের। তিনি মালয়েশিয়ার নটিংহ্যাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইলেকট্রনিকস অ্যান্ড কমিউনিকেশন বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি শেষে দেশে ফিরে আসেন।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা নিজেরাই বিশ্বাস করেন না হাসিব মো. মুয়াম্মার রশিদ নিজে সেবনের জন্য মাদক তৈরির উপকরণ জমা করেছিলেন। এ মামলার দুই নম্বর আসামি জাহাঙ্গীর আলম স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে বলেছেন, তাঁর কাজ ছিল ভবনের মালিক এফ এম রাশিদুজ্জামানের নির্দেশে ভবন থেকে ভাড়া তোলা। তিনি ফুটফরমাশ খাটতেন।

জাহাঙ্গীর তাঁর আইনজীবী কমলকান্ত দাশের হাতে একটি চিরকুটও দিয়েছেন। ওই চিরকুটে তিনি লেখেন, ঘটনার দিন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের আভিযানিক দল তাঁকে ভবন থেকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে আসে। এমনকি সে সময়েও হাসিবের এক বন্ধু এসেছিলেন। তাঁর নাম ইরফান মাহবুব। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর তাঁদের দুজনকে ধরে আনলেও পরে একটা ফোন আসায় ওই তরুণকে ছেড়ে দেন।

উদ্বেগে জাহাঙ্গীরের পরিবার

হাসিব মো. মুয়াম্মার রশিদ নিজে জবানবন্দিতে বলেছেন, জাহাঙ্গীর আলম তাঁর কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে কিছু জানতেন না। তারপরও তাঁর বিরুদ্ধে সহযোগিতার অভিযোগ এনেছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক খোরশিদ আলম প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা যথাযথভাবে তদন্ত করে অভিযোগপত্র দিয়েছেন, কাউকে ফাঁসানোর উদ্দেশ্যে নয়।

জাহাঙ্গীর আলমের ছেলে অনির্বাণ মাহবুব বলেন, বহুবার তাঁর বাবা হাসিবের সন্দেহজনক আচরণের কথা তাঁর বাবাকে জানিয়েছেন। তিনি গা করেননি। উল্টো লোকজনকে বলে বেড়াতেন, তাঁর ছেলে বিজ্ঞানী।