মালিক-শ্রমিকের স্বার্থে সড়ক পরিবহন আইন শিথিল হচ্ছে

রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কে বাসের চাপায় দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যুর প্রতিবাদে রাস্তায় নেমেছিল সারা দেশের শিক্ষার্থীরা। তাদের দাবি ছিল নিরাপদ সড়কের। সেই আন্দোলনের মুখে তড়িঘড়ি করে পাস হয় নতুন সড়ক পরিবহন আইন। ১০ মাস পরও সেই আইন কার্যকর না করে এখন পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের দাবি মেনে তা শিথিল করার পথে হাঁটছে সরকার। অথচ সড়ক দুর্ঘটনার শিকার ব্যক্তি ও পরিবারগুলো এখনো ন্যায়বিচারের অপেক্ষায় প্রহর গুনছে।

নতুন সড়ক পরিবহন আইনে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানির জন্য ৯৮ ও ১০৫ ধারায় শাস্তির বিধান আছে। ১০৫ ধারায় চালকের সর্বোচ্চ সাজা পাঁচ বছর, যা দণ্ডবিধি অনুসারে বিচার হবে। এই ধারায় সর্বোচ্চ পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করার বিধানও রয়েছে। আর ৯৮ ধারায় সর্বোচ্চ সাজা তিন বছরের কারাদণ্ড। এর বিচার হবে মোটরযান আইনে। এতে সর্বোচ্চ তিন লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডের বিধান আছে। জরিমানার একটি অংশ বা পুরোটা দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তকে দিতে পারেন আদালত। আইনে এই দুটি ধারা জামিন অযোগ্য। পরিবহন মালিক-শ্রমিক সংগঠনগুলো এই সাজা ও জরিমানা কমানো, এমনকি আইনে যেসব ধারার অপরাধকে জামিন অযোগ্য করা হয়েছে, সেসব ধারা জামিনযোগ্য করার দাবি তুলেছে। সরকারও আইনটি পরিবর্তনের বিষয়ে কাজ করছে।

গত ১৬ ফেব্রুয়ারি সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিলের সভায় সড়ক পরিবহন আইনের প্রায়োগিক দিক নিয়ে মতামত দেওয়ার জন্য তিনজন মন্ত্রীর সমন্বয়ে একটি কমিটি করা হয়। এই কমিটির সভাপতি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান। অন্য দুই সদস্য হলেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ও রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম। এই কমিটি নিজেরা অনানুষ্ঠানিকভাবে কয়েক দফা আলোচনা করে। এরপর মালিক-শ্রমিক সংগঠনের নেতাদের নিয়ে দুই দফা বৈঠক করে।

সর্বশেষ গত ১২ জুনের বৈঠকে সাজা কমানোর বিষয়ে সুনির্দিষ্ট দাবি তোলেন মালিক-শ্রমিকনেতারা। বৈঠকে উপস্থিত সূত্র জানায়, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের কার্যকরী সভাপতি ও সাবেক নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান ৯৮ ও ১০৫ ধারায় সাজা কমানো এবং এই দুটি ধারার অপরাধকে জামিনযোগ্য করার দাবি করেন। নতুন সড়ক পরিবহন আইনে চালকের লাইসেন্স পেতে সর্বনিম্ন শিক্ষাগত যোগ্যতা অষ্টম শ্রেণি করা হয়েছে। কোনো ব্যক্তি নকল, ভুয়া ও জাল লাইসেন্স ব্যবহার করলে সর্বোচ্চ দুই বছরের কারাদণ্ড এবং পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানার বিধান আছে। শাজাহান খান শিক্ষাগত যোগ্যতার বিষয়টি তুলে দেওয়ার এবং জাল লাইসেন্সের দণ্ড কমানোর দাবি করেন। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতির সভাপতি মসিউর রহমান ও সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলীও আইনের বেশ কয়েকটি ধারা পরিবর্তনের দাবি তোলেন।

এর পরিপ্রেক্ষিতে বৈঠকে ৯৮ ও ১০৫ ধারার অধীনে যে অপরাধের কথা বলা হয়েছে, সেই অপরাধে ভারত, মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরে কী ধরনের দণ্ডের বিধান রয়েছে, তা খতিয়ে দেখে সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়কে মতামত দিতে বলা হয়েছে। এ ছাড়া ৯৮ ধারাটি ভেঙে ভিন্ন ভিন্ন ধারায় অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়েও মন্ত্রণালয়কে দায়িত্ব দেওয়া হয়।

সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, মন্ত্রণালয় মালিক-শ্রমিক সংগঠনের দাবি অনুসারে আইনের কোন কোন ধারায় পরিবর্তন আনা যায়, এই বিষয়ে একটি প্রস্তাব তৈরির কাজ করছে। ৯৮ ধারাকে ভেঙে দুটি ধারায় আনার প্রস্তাব দেবে তারা। এতে করে সাজাও কমে যাবে। অপরাধটি জামিনযোগ্য করার বিবেচনাও তাদের আছে। আর ১০৫ ধারায় সাজা পাঁচ বছর থেকে কমিয়ে তিন বছর করার বিষয়ে সরাসরি কোনো প্রস্তাব করবে না মন্ত্রণালয়। তবে এই ধারার সাজা জামিনযোগ্য করার প্রস্তাব করবে তারা।

>

মালিক-শ্রমিক সংগঠনগুলো পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করছেন সরকারদলীয় নেতারা
পরিবহন শ্রমিক সংগঠনগুলোর একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ শাজাহান খানের হাতে
সাজা-জরিমানা কমানো, জামিন অযোগ্য ধারা জামিনযোগ্য করার দাবি
আইনের প্রায়োগিক দিক নিয়ে মত দেওয়ার জন্য তিন মন্ত্রীর সমন্বয়ে কমিটি

সড়ক পরিবহন আইন নিয়ে তিন মন্ত্রীর কমিটির কার্যক্রম সম্পর্কে জানতে চাইলে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের কমিটির কাজ শেষ পর্যায়ে। আরেকটি বৈঠক করেই তাঁদের সুপারিশ চূড়ান্ত করা হবে। মালিক-শ্রমিকনেতাদের দাবি সম্পর্কে আইনমন্ত্রী বলেন, মালিক-শ্রমিকদের যেকোনো দাবি করার অধিকার আছে। তবে যুক্তিসংগত দাবিই বিবেচনা করা হবে।

সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, বর্তমানে মালিক-শ্রমিক সংগঠনগুলো পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করছেন সরকারদলীয় নেতারা। পরিবহন শ্রমিক সংগঠনগুলোর একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ শাজাহান খানের হাতে। মালিক সমিতির সভাপতি জাতীয় পার্টির মহাসচিব মসিউর রহমান হলেও এর মূল নিয়ন্ত্রক সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক খোন্দকার এনায়েত উল্যাহ। এনায়েত ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি। এই সংগঠনগুলোকে সরকার সহায়ক শক্তি হিসেবে মনে করে। এ জন্য সরকার তাদের চটাতে চাইছে না। বিশেষ করে ২০১৩ ও ২০১৫ সালে বিএনপি-জামায়াতের হরতাল-অবরোধের সময় মালিক-শ্রমিক সংগঠনগুলো সরকারকে সমর্থন দেয়। হরতাল-অবরোধে ঝুঁকি নিয়ে যানবাহন চালায়।

আইন পরিবর্তনের বিষয়ে শাজাহান খান প্রথম আলোকে বলেন, দুর্ঘটনার অপরাধ জামিন অযোগ্য ধারায় নেওয়ার বিধান অযৌক্তিক। এটা কোথাও নেই। এ জন্য তাঁরা পরিবর্তন চেয়েছেন। আর দুর্ঘটনার সাজাসহ আরও বেশ কিছু অযৌক্তিক ধারা নিয়ে তাঁরা সুনির্দিষ্ট মতামত দিয়েছেন। এখন সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার তিন মন্ত্রীর সমন্বয়ে গঠিত কমিটির।

মালিক-শ্রমিকের চাপ আগেও ছিল
নিরাপদ সড়কের দাবিতে ছাত্র আন্দোলনের মুখে সরকার গত বছর ১৯ সেপ্টেম্বর তড়িঘড়ি করে নতুন সড়ক পরিবহন আইন সংসদে পাস করে। ৮ অক্টোবর আইনের গেজেট হয়। কিন্তু আইনে বলা আছে, সরকার গেজেট প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে যে তারিখ নির্ধারণ করবে, সেই তারিখ থেকে তা কার্যকর হবে। কিন্তু গত বছরের ২৮ অক্টোবর থেকে সারা দেশে ৪৮ ঘণ্টার পরিবহন ধর্মঘট করে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন। এ সময় শ্রমিকদের হাতে লাঞ্ছিত হন ব্যক্তিগত গাড়ির চালক, আরোহী, মোটরবাইক ও ইজিবাইকের চালকেরা। কলেজছাত্রী, অফিসগামী নারী ও ছোট যানের চালকদের মুখে পোড়া মবিল-কালি মেখেও দেন তাঁরা। এর ফলে আইন পাস হওয়ার পর ১০ মাসেও তা কার্যকর করেনি সরকার।

প্রয়াত এইচ এম এরশাদের শাসনামলে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানিতে চালকের সর্বোচ্চ শাস্তি সাত বছর করা হয়। এরপর মালিক-শ্রমিকদের আন্দোলনের মুখে দণ্ডবিধি পরিবর্তন করে শাস্তি কমিয়ে তিন বছর করা হয়। এখন পর্যন্ত সেই শাস্তিই বলবৎ আছে। তবে ইচ্ছাকৃতভাবে কেউ দুর্ঘটনা ঘটিয়ে হত্যা করলে ৩০৪ ধারায় অর্থাৎ যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের সুযোগ আছে।

রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের ভাইস চেয়ারম্যান ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া প্রথম আলোকে বলেন, আইনটি কার্যকর করার আগেই পরিবর্তনের আলোচনা সড়ক নিরাপত্তার দাবিতে আন্দোলন করা শিক্ষার্থী, যাঁরা নির্যাতন ও কারাভোগের শিকার হয়েছেন, যাঁরা দুর্ঘটনায় মারা গেছেন তাঁদের জন্য অপমানজনক। তিনি বলেন, আইন দরকার। তবে পাশাপাশি পরিবহন খাতে যে নৈরাজ্য, সড়কের যে ত্রুটি, পরিবহন চালকদের সুরক্ষার যে অভাব, তা-ও সমাধান করতে হবে।