রাষ্ট্রপতির ক্ষমার পরও কারাগারে থাকা আজমত অবশেষে মুক্তি পাচ্ছেন

রাষ্ট্রপতির সাধারণ ক্ষমা পাওয়ার পরও ৯ বছরের বেশি সময় ধরে কারাগারে থাকা জামালপুরের আজমত আলী অবশেষে মুক্তি পেতে যাচ্ছেন। সাবেক এই স্কুলশিক্ষককে অবিলম্বে মুক্তি দিতে নির্দেশ দিয়েছেন দেশের সর্বোচ্চ আদালত।

যাবজ্জীবন দণ্ডাদেশের রায় পুনর্বিবেচনা চেয়ে আজমত আলীর করা আবেদন (রিভিউ) নিষ্পত্তি করে গত ২৭ জুন ওই রায় দেন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বাধীন ছয় সদস্যের আপিল বিভাগ। আজ সোমবার পূর্ণাঙ্গ রায়টি প্রকাশিত হয়।

রায়ে আদালত বলেছেন, রাষ্ট্রপতির ক্ষমার পরও আবেদনকারীকে (আজমত) আবার জেলে পাঠানো অযৌক্তিক ও অপ্রত্যাশিত। প্রয়োজনীয় পদক্ষেপের জন্য সুপ্রিম কোর্ট থেকে ওই রায়ের প্রত্যয়িত অনুলিপি আজই জামালপুরের দায়রা জজ ও জেলার বরাবরে পাঠানো হয়।

জামালপুরের সরিষাবাড়ী উপজেলার তারাকান্দি এলাকার পাখিমারা গ্রামের ইজ্জত উল্ল্যা সর্দারের ছেলে আজমত আলী। টাঙ্গাইলের গোপালপুর উপজেলার ঘোড়ামারা এলাকার ভেঙ্গুলা উচ্চবিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক ছিলেন তিনি। রাষ্ট্রপতির সাধারণ ক্ষমায় কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন তিনি। উচ্চ আদালতের রায়েও তিনি খালাস পান। কিন্তু মুক্তি পাওয়ার ১৩ বছর পর আবার সে মামলার কার্যক্রম শুরু হয়। এরপর পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করে। সেই থেকে কারাগারে আছেন এই বৃদ্ধ।

খুনের ওই মামলায় নিম্ন আদালত থেকে যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আজমত আলীর পক্ষে যাবতীয় কাগজপত্রও আদালতে দাখিল করা হয়। শুরু হয়েছিল চিঠি চালাচালি। কিন্তু কোনো সিদ্ধান্ত না পেয়ে আজমতের মেয়ে বিউটি খাতুন তাঁর বাবার বিষয়ে আইনি সহায়তার জন্য গত বছর সুপ্রিম কোর্ট লিগ্যাল এইড কমিটির কাছে আবেদন করেন। এর ধারাবাহিকতায় আপিল বিভাগে রিভিউ (পুনর্বিবেচনা) আবেদন করেন আজমত আলী।

আদালতে আজমতের পক্ষে শুনানি করেন লিগ্যাল এইড কমিটির সদস্য ও সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এ এম আমিন উদ্দিন। রাষ্ট্রপক্ষে শুনানিতে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বিশ্বজিৎ দেবনাথ।

রাষ্ট্রপতির ক্ষমার পরও ৯ বছরের বেশি সময় ধরে ওই ব্যক্তির কারাগারে থাকা কারা কর্তৃপক্ষের সমন্বয়হীনতার অভাব বলে মনে করেন আইনজীবী এ এম আমিন উদ্দিন। আজ সোমবার তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এ বিষয়ে কারা কর্তৃপক্ষ আরও কার্যকর ভূমিকা নিলে এবং লিগ্যাল এইড কমিটির সঙ্গে সমন্বয় করে পদক্ষেপ নিলে সে ক্ষেত্রে এ ধরনের দুর্ভাগ্যজনক ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধ করা সম্ভব হবে।

ঘটনার পূর্বাপর
১৯৮৭ সালের ১ এপ্রিল জমি নিয়ে বিরোধের জেরে এলাকার কলিম উদ্দিনের ছেলে রেজাউল করিম নিহত হন। এই ঘটনায় আজমত আলীকে আসামি করে হত্যা মামলা করা হয়। এ মামলায় ১৯৮৯ সালের ৮ মার্চ জামালপুরের জেলা ও দায়রা জজ আদালত তাঁকে যাবজ্জীবন সাজা দেন। বিচারিক আদালতের সাজার রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল করেন আজমত আলী। একই সময় তিনি রাষ্ট্রপতির সাধারণ ক্ষমার জন্যও আবেদন করেন। আপিল বহাল থাকার সময় রাষ্ট্রপতির ক্ষমায় ১৯৯৬ সালের ২১ আগস্ট জামালপুর কারাগার থেকে মুক্তি পান তিনি। আবার ২০০৫ সালের ২ মার্চ হাইকোর্টের রায়েও তিনি খালাস পান। এভাবে ১৩ বছর কেটে যায়। তবে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে লিভ টু আপিল করে রাষ্ট্রপক্ষ, যার পরিপ্রেক্ষিতে আদালত ২০০৮ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি আসামিকে (আজমত আলী) নিম্ন আদালতে হাজির হতে নির্দেশ দেন। ২০০৯ সালের ১৯ অক্টোবর গ্রামের বাড়ি থেকে আজমতকে গ্রেপ্তার করে নিম্ন আদালতে সোপর্দ করে পুলিশ। সে সময় থেকে কারাগারে আছেন তিনি। অন্যদিকে ২০১০ সালের ১১ আগস্ট রাষ্ট্রপক্ষের আপিলে আসা রায়ে হাইকোর্টের রায় (খালাস) ও আদেশ রদ করে নিম্ন আদালতের রায় (যাবজ্জীবন) ও আদেশ বহাল রাখা হয়। এই রায় পুনর্বিবেচনা চেয়ে গত বছর আপিল বিভাগে আবেদন করেন আজমত আলী।

কথা হয় আজমত আলীর বড় মেয়ে বিউটি খাতুনের সঙ্গে। জামালপুর সদরের ডোয়াইলপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী এই শিক্ষক আজ প্রথম আলোকে বলেন, মুক্তির খবরে আনন্দিত। তবে ২০০৯ সাল থেকেই আমরা কষ্ট করে আসছি। আদালতসহ বিভিন্ন দপ্তরে গিয়েছি, প্রতিকার পাইনি। এরপর সুপ্রিম কোর্ট লিগ্যাল এইড কমিটির কাছে যাই। কমিটি আইনি সহায়তায় এগিয়ে আসে। সে জন্য কমিটিকে ধন্যবাদ। তবে ওই ঘটনায় আমাদের পুরো পরিবার আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। রাষ্ট্রপতির ক্ষমার পরও বাবাকে নয় বছরের বেশি সময় কারাভোগ করতে হয়েছে। এই ঘটনায় ক্ষতিপূরণ দাবি করেন তিনি।