জাপার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দ্বন্দ্বের আশঙ্কা

জাতীয় পার্টি
জাতীয় পার্টি

জাতীয় পার্টির (জাপা) ‘প্রাণশক্তি’ ছিলেন দলের প্রতিষ্ঠাতা এইচ এম এরশাদ। তাঁর মৃত্যুতে দলের শক্তি অনেকটাই ক্ষয় হয়েছে বলে মনে করেন নেতা-কর্মীরা। এরশাদের অবর্তমানে দলীয় সংহতি কতটা অটুট থাকবে, ভবিষ্যতে জাপার রাজনৈতিক চরিত্র কেমন হবে, তা নিয়েও জল্পনাকল্পনা শুরু হয়েছে।

এরশাদের জীবদ্দশাতেই আলোচনা ছিল, তাঁর মৃত্যুর পর দলের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দ্বন্দ্ব দেখা দিতে পারে। বিষয়টি এরশাদের বিবেচনাতেও ছিল। যে কারণে এরশাদ তাঁর রাজনৈতিক উত্তরাধিকার হিসেবে ভাই জি এম কাদেরকে বেছে নেন। তবে তাঁর স্ত্রী রওশন এরশাদ তা মন থেকে মেনে নেননি বলে আলোচনা আছে। এ নিয়ে রওশন এবং জি এম কাদেরের অনুসারীদের মধ্যে একধরনের দূরত্ব চলে আসছিল।

আবার দলের জ্যেষ্ঠ নেতাদের একটি অংশও জি এম কাদেরকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করা মেনে নিতে পারেনি। তাঁরাও রওশনের পথ অনুসরণ করে জি এম কাদেরকে এড়িয়ে চলছেন। দলীয় কর্মসূচি ও বৈঠকে তাঁদের উপস্থিতি কম থাক। এ অংশ রওশন এরশাদকে সামনে রেখে দল পরিচালনার চেষ্টা করছে। তাঁদের মধ্যে আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদার, কাজী ফিরোজ রশীদ, ফখরুল ইমামসহ আরও অনেক জ্যেষ্ঠ নেতা রয়েছেন বলে দলে আলোচনা আছে। যদিও এখন পর্যন্ত তাঁদের তৎপরতা প্রকাশ্য নয়।

এ বিষয়ে জাপার সাবেক মহাসচিব রুহুল আমিন হাওলাদার প্রথম আলোকে বলেন, ‘যদি কোনো পক্ষ থেকে ভাগাভাগির প্রশ্ন ওঠে, তা হবে চরম অনাকাঙ্ক্ষিত। আমাদের আন্তরিক চেষ্টা হবে দলকে ঐক্যবদ্ধ রাখা। কারণ, দলকে সম্মানজনক অবস্থানে রাখতে হলে ঐক্যের কোনো বিকল্প নেই।’

দলের নেতারা জানান, গতকাল জাতীয় সংসদ ভবন প্রাঙ্গণে এরশাদের জানাজার আগে পরিবারের পক্ষ থেকে রওশন এরশাদ বক্তব্য দেওয়ার সময় পেছন থেকে কিছু কর্মী-সমর্থক হইচই করেন। এরপর জি এম কাদেরের বক্তব্য দেওয়ার সময়ও একই ধরনের ঘটনা ঘটে।

একাদশ জাতীয় সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা ছিলেন এরশাদ। প্রথমে জি এম কাদেরকে সংসদের বিরোধীদলীয় উপনেতা মনোনীত করেন তিনি। পরে সিদ্ধান্ত পাল্টে স্ত্রী রওশনকে ওই পদ দেন। দলীয় সূত্র জানায়, এরশাদের মৃত্যুর পর রওশন, নাকি দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান জি এম কাদের বিরোধীদলীয় নেতা হবেন, তা নিয়ে জটিলতা দেখা দিতে পারে। এ ক্ষেত্রে দলের সাংসদদের মতামত এবং দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্যদের সমর্থন বিবেচনায় নেওয়া হবে কি না, এসব বিষয়ে নেতা-কর্মীদের মধ্যে আলোচনা আছে।

>

রাজনৈতিক উত্তরাধিকার হিসেবে ভাই জি এম কাদেরকে মনোনীত করে গেছেন এরশাদ
স্ত্রী রওশন এরশাদ তা মন থেকে মেনে নেননি বলে আলোচনা আছে

এরশাদের নিকটাত্মীয় ও দলের সভাপতিমণ্ডলীর গুরুত্বপূর্ণ সদস্য জিয়াউদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আশা করি দলে কোনো বিভক্তি হবে না, করতে দেব না।’

জাপার দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানায়, এরশাদের মৃত্যুর আগে তাঁর সাবেক স্ত্রী ও ছেলে এরিকের মা বিদিশা জাপার রাজনীতিতে যুক্ত হওয়ার আগ্রহ দেখিয়েছেন। তিনি দলের প্রভাবশালী কয়েকজন নেতার সঙ্গেও বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছেন। এরশাদের মৃত্যুর পর এরিকের মা হিসেবে সন্তানের দেখভাল করতে চান বিদিশা। গতকাল সোমবার সকালে বিদিশা বারিধারায় এরশাদের বাসভবন প্রেসিডেন্ট পার্কে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু নিরাপত্তাকর্মীরা তাঁকে যেতে দেননি।

এ নিয়ে বিদিশা ফেসবুকে লেখেন, ‘...আমার সঙ্গে এরিককে কথাও বলতে দেওয়া হচ্ছে না। দেখা করা তো দূরের কথা। এমনিতেই আমার ছেলে প্রতিবন্ধী। এই সময়ে যেখানে মাকে বেশি প্রয়োজন, তখন আমার ছেলেকে নিয়েও রাজনীতি চলছে...।’

জাপার নেতারা বলছেন, নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানে পতনের পর এরশাদ ও তাঁর দল জাপা টিকে থাকবে, এমন ধারণা ছিল না অনেকের। প্রায় ৩০ বছর ধরে জাপা টিকে আছে এবং প্রধান দুটি দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির ক্ষমতায় যাওয়া, না যাওয়া অনেকাংশে নির্ভর করে দলটির সমর্থনের ওপর। এ ক্ষেত্রে এরশাদের ভূমিকাই ছিল মুখ্য।

দলের সাবেক মহাসচিব জিয়াউদ্দিন আহমেদ মনে করেন, সঠিকভাবে রাজনীতি করতে পারলে জাতীয় পার্টি এগিয়ে যেতে পারবে। তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগ ও বিএনপি যাঁরা প্রতিষ্ঠা করেছেন, তাঁরাও এখন নেই। এরশাদ শারীরিকভাবে উপস্থিত নেই, কিন্তু তাঁর উন্নয়ন, সংস্কার, উপজেলা, যমুনা সেতু, এলজিইডি-এসব তো আছে। এগুলোই হবে আমাদের প্রাণশক্তি।’

অবশ্য রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের কারও কারও মতে, জাতীয় পার্টির রাজনীতিই ছিল এরশাদকে ঘিরে, তাঁর কারণেই দলটি এত দিন টিকে ছিল। এরশাদবিহীন এই দলের ভবিষ্যৎ তেমন দেখেন না অনেকে।

এমন পর্যবেক্ষণের সঙ্গে অবশ্য একমত নন জাপার মহাসচিব মসিউর রহমান। তিনি বলেন, যাঁরা দলে বিশৃঙ্খলা করতে চান, তাঁরা সুবিধা করতে পারবেন না। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান জি এম কাদের দলকে একতাবদ্ধ রাখবেন। দল ভেঙে যাওয়ার কোনো প্রশ্নই ওঠে না।