ঢাকায় ১১০০ মাঠের সংকট

কোটি মানুষের শহর ঢাকা। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের হিসাবে ঢাকায় এখন প্রতি বর্গকিলোমিটারে প্রায় ৪৫ হাজার মানুষের বাস। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার মতে, একটি শহরে প্রতিটি মানুষের জন্য থাকতে হবে ৯ বর্গমিটার খোলা জায়গা, ঢাকায় তা আছে মাত্র ১ বর্গমিটার। জনসংখ্যার হিসাবে যেখানে ঢাকায় থাকার কথা ছিল প্রায় ১ হাজার ৩০০ খেলার মাঠ, সেখানে দুই সিটি করপোরেশনের কাছে আছে মাত্র ২৩৫টি খেলার মাঠ, অর্থাৎ মাঠের ঘাটতি প্রায় ১ হাজার ১০০।

নগর-পরিকল্পনাবিদেরা বলছেন, এই মাঠগুলো বড় মাঠ হতে হবে, এমন কোনো কথা নেই। এলাকার মধ্যে ছোট ছোট খোলা জায়গা থাকতে হবে, যেখানে সব বয়সের মানুষ খেলাধুলা, হাঁটাহাঁটি করতে পারেন। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, ন্যূনতম প্রয়োজনীয় সেই জায়গাগুলোও নেই। এমনকি আধুনিক সুবিধাসম্পন্ন হাউজিং প্রকল্পেও এ ধরনের পর্যাপ্ত মাঠ রাখা হচ্ছে না।

একটা নগরে মাঠের হিসাব করা হয় জনসংখ্যার ঘনত্বের ওপর ভিত্তি করে। সে হিসাবে, প্রতি সাড়ে ১২ হাজার মানুষের জন্য প্রয়োজন কমপক্ষে দুটো মাঠ, বলেন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সাধারণ সম্পাদক আদিল মুহাম্মদ খান। সে হিসাবে ঢাকার জনসংখ্যার ভিত্তিতে আরও ১ হাজার ৭১টি মাঠ থাকা প্রয়োজন ছিল। বিআইপির তথ্যমতে, উত্তরে ৩৬টি ওয়ার্ডে মাঠের ঘাটতি আছে ৬১০টি। আর দক্ষিণে ৫৬টি ওয়ার্ডে মাঠের ঘাটতি ৪৬১টি। অপরিকল্পিত ও নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে গড়ে ওঠা ঢাকায় একটিও মাঠ নেই—এমন ওয়ার্ডের সংখ্যা চার। এই ওয়ার্ডগুলো হচ্ছে দক্ষিণ-৫৫ ও ৬৫ (কামরাঙ্গীরচর) এবং উত্তর-৩০ (মোহাম্মদিয়া হাউজিং) ও উত্তর-৩৩ (আদাবর)।

বিআইপির গবেষণা অনুযায়ী, ঢাকার সিটি করপোরেশনে মাঠ আছে ২৩৫টি, কিন্তু এই মাঠগুলোর মধ্যে মাত্র ৪২টি মাঠে আছে সাধারণের প্রবেশ অধিকার। প্রতিষ্ঠানের অধিকারে মাঠ আছে ১৪১টি আর কলোনির মাঠ আছে ২৪টি, যার মধ্যে ওই নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠান বা কলোনির মানুষদের জন্য সংরক্ষিত। এর বাইরে ঈদগাহ মাঠ আছে ১২টি, যেখানে সুযোগ আছে খেলাধুলা করার। আর ১৬টি মাঠ দখল করে আছে কোনো না কোনো সাংস্কৃতিক বা সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) যুগ্ম সম্পাদক স্থপতি ইকবাল হাবিব দীর্ঘদিন কাজ করছেন ঢাকার মাঠগুলো দখলমুক্ত রাখতে। তাঁর মতে, দখল হওয়া মাঠের সংখ্যা শুধু ১৬ নয়, পুরোনো নথি ঘাঁটলেই জানা যাবে, আসলেই কতগুলো মাঠ দখল হয়েছে।

গুলশানের মতো পরিকল্পিত অভিজাত আবাসিক এলাকাগুলোয় পর্যন্ত প্রতিটি রোডে আলাদা আলাদা মাঠ ছিল, এখন আর নেই। বিভিন্ন সময় এই মাঠগুলো দখল হয়েছে, বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে আবাসিক ভবনের। এখন কাগজে-কলমেও সেই মাঠগুলোর অস্তিত্ব নেই, বলেন ইকবাল হাবিব। বনানী, গুলশান-১ ও ২, গুলশান সুইপার কলোনি (১), কড়াইল নিয়ে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ১৯ নম্বর ওয়ার্ড। বিআইপির হিসাবে এই ওয়ার্ডে ১ লাখ ২৫ হাজার বাসিন্দার জন্য মাঠের ঘাটতি আছে ১৩টি।

স্থপতি ইকবাল হাবিব আরও বলেন, ‘সম্প্রতি ঢাকার পার্ক ও মাঠগুলোর উন্নয়ন প্রকল্পে কাজ করতে গিয়েও আমরা দেখেছি, দখলমুক্ত উল্লেখ করা খেলার মাঠগুলোর ভেতরে ওয়াসার পাম্প, দোকান, সিটি করপোরেশনের আবর্জনার সেকেন্ডারি ল্যান্ডিং স্টেশনের মতো স্থাপনা আছে, যা মাঠকে খেলার অনুপযুক্ত করেছে।’

মাঠের অপর্যাপ্ততা শিশুদের বিকাশে বিরূপ ভূমিকা রাখে, শিশুরা হয়ে পড়ে অনিরাপদ, বলেন উন্নয়ন সংস্থা সেভ দ্য চিলড্রেনের উপপরিচালক (ঝুঁকি হ্রাস ও জলবায়ু পরিবর্তন অভিযোজন) সৈয়দ মতিউল আহসান। তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের একটি প্রকল্প “প্রয়াস-২”, যার মাধ্যমে আমরা চেষ্টা করছি শিশুদের ভাবনাটাকে নীতিনির্ধারকদের কাছে নিয়ে আসতে, যেন নতুন যেসব নগর পরিকল্পনার আওতায় আসছে বা “ডিটেল এরিয়া প্ল্যান” করার সময় একটি নগরে শিশুদের চাহিদার বিষয়গুলোকে যুক্ত করা হয়।’

প্রয়াস প্রকল্পের এক অনুষ্ঠানে গিয়েই জানা যায়, রাজধানীর খোলা জায়গা নিয়ে আরেকটি দোলাচল হলো, ‘খোলা জায়গাটি খেলার মাঠ, নাকি পার্ক?’

ঢাকার যতগুলো এলাকায় মাঠের অপ্রতুলতা আছে, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য উত্তরা। ২ লাখ ৩৮ হাজার বাসিন্দার আবাস মডেল টাউন উত্তরায় মাঠের অপ্রতুলতা রয়েছে ২৫টি। তবে এখানে রয়েছে কিছু পার্ক। সে রকম একটি পার্ক উত্তরা হাইস্কুলের পাশের পার্কটি, যার বাইরে লেখা, ‘পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের কাজের সুবিধার্থে বেলা ১১টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত প্রবেশ নিষেধ’। এই স্কুলের একজন প্রাক্তন শিক্ষার্থী নিয়ামুল ইসলাম বলেন, এই সময়ের মধ্যে স্কুলের মর্নিং শিফট ছুটি হয়ে ডে শিফটের ক্লাস শুরু হয়। এই অপেক্ষমাণ শিক্ষার্থী ও অভিভাবকেরা দাঁড়িয়ে থাকেন স্কুলের বাইরে, তবুও পার্কে ঢোকার অনুমতি পান না।

সরেজমিনে দেখা যায়, শুধু ঢোকা নয়, পার্কটিতে কিছুটা খেলার জায়গা থাকা সত্ত্বেও সাইনবোর্ড টাঙিয়ে সেখানে নিষেধাজ্ঞা করা হয়েছে সব ধরনের খেলাধুলাকে।

পার্কটির ঠিক পাশে উত্তরা হাইস্কুল। বিকেলে স্কুলের বিশাল মাঠটি পড়ে থাকে খালি। অন্য সব জায়গার মতো এখানেও খেলার অনুমতি নেই সাধারণের। তাই আদতে রাজধানীর খেলার মাঠ সর্বসাকল্যে সেই উন্মুক্ত ৪২টি বা ঈদগাহের মাঠ হিসাবে আনলে ৫৪টি। সেগুলোরও আরেক বাস্তবতা হচ্ছে, প্রায়ই তাতে আয়োজন করা হয় মৌসুমি মেলার। এ কারণে মাঠের মূল উদ্দেশ্য ব্যাহত হয়।

স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, পার্ক বা মাঠ থাকা মানেই যে সব বয়সীরা সেখানে খেলতে পারবে, এমন না। অধিকাংশ মাঠ সক্ষম পুরুষদের দখলে। কম বয়সী বা নারীরা মাঠের সুবিধা থেকে সব সময় বঞ্চিতই থেকে যান।

মিরপুর উদয়ন স্কুলের শিক্ষার্থী সদিয়া বলেন, ‘মিরপুর–১১, যেখানে আমরা থাকি, সেখানে একটা মাঠ আছে বটে তবে সেখানে ছেলেরাই শুধু খেলে। আমাদের জন্য কোনো জায়গা বা সময় নেই। ফলে, আমাদের বাবা-মা আমাদের ঘরেই বন্দী করে রাখেন।’

শিশুদের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ ও চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে খেলার মাঠের এই বিশাল সংকট নিরসনে প্রতিষ্ঠানের মাঠগুলোর উপযোগিতা বৃদ্ধি করে সাময়িক সমাধান চাইছেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘আমরা চেষ্টা করছি প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে যোগাযোগের, যেন তাদের প্রাতিষ্ঠানিক কাজের পরে মাঠগুলোয় সাধারণের ব্যবহারের অনুমতি পাওয়া যায়। ...এ ছাড়া ঢাকার মানুষকে কিছুটা স্বস্তি দিতে আমরা উত্তর সিটি করপোরেশনে আরও ২৪টি মাঠ তৈরি করছি।’

স্থপতি ইকবাল হাবিব কাজ করছেন নতুন করে তৈরি হওয়া এই মাঠ প্রকল্পে। তিনি বলেন, ‘নতুন প্রোজেক্টগুলোয় আমরা চেষ্টা করেছি স্থানের সর্বোচ্চ ব্যবহার করতে। তাই নকশায় আমরা আগে একটি খেলার মাঠ আঁটানোর চেষ্টা করেছি, এরপর যা ফাঁকা জায়গা পাওয়া গেছে, তাতে বিভিন্ন বয়সীদের জন্য বসার জায়গা, খেলার জায়গার পরিকল্পনা করা হয়েছে।’

তারপরও ঢাকার মানুষের বিশাল সংখ্যার সাপেক্ষে মাঠের সংখ্যা অপ্রতুল বলে মনে করেন ইকবাল হাবিব। তিনি জানান, রাজউকের এক হিসাবমতে, ঢাকায় এখনো দখল হয়ে যাওয়া মাঠ ও পার্কের পরিমাণ ৬ হাজার ৯০০ একর।

বিআইপির সাধারণ সম্পাদক আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, ঢাকাকে বাসযোগ্য করতে হলে দখল হয়ে যাওয়া মাঠগুলো উদ্ধার করতে হবে। আপাতদৃষ্টিতে তা কঠিন মনে হলেও অসম্ভব নয় বলেই মনে করেন এই নগর–পরিকল্পনাবিদ। তাঁর মতে, সরকার যদি চায় তবে মেগা প্রজেক্ট হাতে নিয়ে ভূমি অধিগ্রহণ করে হলেও ফিরিয়ে আনা যায় মাঠ।

দখল হয়ে হিসাবের বাইরে চলে যাওয়া মাঠগুলোর বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে উত্তরের মেয়র বলেন, ‘এই বিষয়ে আমরা শিগগিরই ব্যবস্থা নেব। ইতিমধ্যে আমি সব কাউন্সিলরকে জানিয়ে দিয়েছি নিজ নিজ এলাকার দখল হয়ে যাওয়া মাঠের বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে। আমরা জনগণকে তাদের মাঠ ফিরিয়ে দিতে চাই।’