অরক্ষিত রেলক্রসিংয়ে বারবার প্রাণহানি

সিরাজগঞ্জ জেলায় রেলক্রসিং রয়েছে ৪৪টি। এর মধ্যে ১৪টি অরক্ষিত। এসব অরক্ষিত রেলক্রসিংয়ে ট্রেন চলাচলের সময় যানবাহন নিয়ন্ত্রণের কোনো প্রতিবন্ধক (গেট) নেই। সতর্কতামূলক নোটিশ বোর্ড টাঙিয়ে দিয়েই দায়িত্ব শেষ করেছে রেল কর্তৃপক্ষ। এমনই একটি অরক্ষিত ক্রসিং পার হওয়ার সময় দুর্ঘটনায় গত সোমবার বর–কনেসহ ১২ জন প্রাণ হারিয়েছেন।

রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ বলছে, সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর (সওজ) এবং স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) যেখানে-সেখানে রেললাইনের ওপর দিয়ে রাস্তা তৈরি করে রেখে যায়। এসব সড়ক দিয়ে যান চলাচলের সময় দুর্ঘটনা ঘটছে। যে সংস্থা সড়ক নির্মাণ করে, সেই সংস্থারই রেলক্রসিংয়ে গেট নির্মাণের ব্যয় বহন করার কথা। সেটা করা হয় না বলেই রেলক্রসিং অরক্ষিত থেকে যাচ্ছে। বিশেষ করে এলজিইডির সড়ক বেশি অরক্ষিত। 

তবে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের সিরাজগঞ্জ কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মিজানুর রহমান বলেন, রেল কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নিয়েই তাঁরা সড়কটি করছেন। অরক্ষিত রেলপথ দেখার দায়িত্ব তাঁদের নয়। 

গত সোমবার সন্ধ্যায় রাজশাহী-ঢাকা রেলপথে সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া বেতকান্দি এলাকায় বরযাত্রীবাহী একটি মাইক্রোবাস অরক্ষিত রেলক্রসিং পার হওয়ার সময় ট্রেনের ধাক্বায় ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারান নয়জন। পরে হাসপাতালে নেওয়ার পরে দুজন এবং গতকাল মঙ্গলবার আরও একজনের মৃত্যু হয়। এর আগে গত ১৩ এপ্রিল একই রেলপথে উল্লাপাড়ার পাশের কামারখন্দ উপজেলায় অরক্ষিত আরেকটি রেলক্রসিংয়ে ট্রেনের ধাক্কায় মিনি ট্রাকের তিন যাত্রী নিহত হন।

উল্লাপাড়া ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের স্টেশন অফিসার মো. নাদির প্রথম আলোকে বলেন, প্রতিবছরই এসব অরক্ষিত রেলক্রসিংয়ে ৮-১০টি দুর্ঘটনা ঘটে। চলতি বছরেই তিনটি দুর্ঘটনায় ১৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। 

উল্লাপাড়ার বেতকান্দির ওই রেলক্রসিংয়ে গতকাল সকালে গিয়ে দেখা যায়, রেল কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধানে কয়েকজন লোক বাঁশ দিয়ে অস্থায়ী গেট তৈরির কাজ করছেন। পশ্চিমাঞ্চল রেলের ঊর্ধ্বতন উপসহকারী প্রকৌশলী মো. জুয়েল মিঞা জানান, অস্থায়ী গেট করার পাশাপাশি গেটম্যানের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। জেলায় ৪৪টি রেলক্রসিংয়ের মধ্যে ৩০টিতে প্রতিবন্ধক ও প্রহরী আছেন। বাকিগুলো পর্যায়ক্রমে সুরক্ষার ব্যবস্থা করা হবে। 

স্থানীয় বাসিন্দা মো. শাহিন ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, এ জায়গায় প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটে। কিন্তু কারও কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। এবারে ১২ জন নিহত হওয়ার পরে সবাই নড়েচড়ে উঠেছে। মনে হয় এবার কিছু হবে।

স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য ও বেতকান্দি গ্রামের বাসিন্দা আবদুস সামাদ বলেন, ২০০৬ সালে সড়কটি পাকা করা হলে যানবাহন চলাচল শুরু করে এবং দুর্ঘটনা ঘটতে থাকে। 

পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের পাকশী বিভাগীয় প্রকৌশলী-২ আরিফুল ইসলাম বলেন, যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়নে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন সড়ক নির্মাণ করা হচ্ছে। কিন্তু সড়ক নির্মাণকারী সংস্থাগুলো তাঁদেরকে কিছু জানাচ্ছে না। ইচ্ছামতো তারা রেললাইনের ওপর দিয়ে সড়ক নির্মাণ করছে। লোকবল না থাকায় এসব ক্রসিং সর্বদা অরক্ষিত থাকছে। ঘটছে দুর্ঘটনা।

আনন্দের বদলে শোক

আনন্দ–উচ্ছ্বাসে মুখর থাকার কথা ছিল বিয়েবাড়ি। সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার কালিয়াকান্দাপাড়া বাড়িতেই চলছে মাতম। একমাত্র ছেলেকে হারানোর শোক কিছুতেই সইতে পারছেন না আলতাফ হোসেন। ক্ষণে ক্ষণে মূর্ছা যান তিনি। গত সোমবার উল্লাপাড়ায় রেলক্রসিংয়ে ট্রেনের ধাক্কায় নিহত ১২ জনের মধ্যে তাঁর ছেলে (বর) রাজন মণ্ডল, পুত্রবধূ সুমাইয়া খাতুনসহ সাতজন রয়েছেন।

ছেলে হারানো রাজনের বাবা আলতাফ হোসেন বলেন, অরক্ষিত রেলক্রসিংয়ের কারণে আর যেন কেউ প্রাণ না হারায়। 

সুমাইয়ার বাড়ি উল্লাপাড়া পৌরসভার গুচ্ছগ্রামে। গতকাল সকালে তাঁর মরদেহ রাখা ছিল বাড়িতে বরকে বসানোর জন্য বানানো প্যান্ডেলের সামনে। পাশেই স্বজনেরা বিলাপ করছেন। তাঁর ভাই আশরাফুল ইসলাম বলেন, ‘ছোট বোনকে হাসিমুখে স্বামীর ঘরে পাঠাতে চেয়েছিলাম আমরা। স্বামী–স্ত্রী দুজনেই বিয়ের দিনই কবরে চলে গেছে।’