সার্বিক পরিস্থিতির উন্নতি

>

কুশিয়ারা নদীর পানিতে ঘর ডুবে গেছে। ঘর ছেড়ে তাই সড়কে আশ্রয় নিয়েছে বাসিন্দারা। গতকাল মৌলভীবাজার সদরের খলিলপুর ইউনিয়নের হামরকোনা গ্রামে।  ছবি: প্রথম আলো
কুশিয়ারা নদীর পানিতে ঘর ডুবে গেছে। ঘর ছেড়ে তাই সড়কে আশ্রয় নিয়েছে বাসিন্দারা। গতকাল মৌলভীবাজার সদরের খলিলপুর ইউনিয়নের হামরকোনা গ্রামে। ছবি: প্রথম আলো

বেশিরভাগ জায়গায় বন্যার পানি কমলেও বন্যা আক্রান্ত মানুষের দুর্ভোগ কমেনি। অপর্যাপ্ত ত্রাণ তৎপরতা।

সুনামগঞ্জে গত সোমবার রাত থেকে বৃষ্টি না হওয়ায় সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। কমতে শুরু করেছে নদীর পানি। তবে মৌলভীবাজারে কুশিয়ারা নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। পানি বৃদ্ধি পেয়ে নদীপারের অন্তত পাঁচটি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।

মৌলভীবাজার : সড়কের দুপাশে অনেকগুলো সাদা ও রঙিন পলিথিনে মোড়ানো বাঁশের তৈরি অস্থায়ী ঘর। কোনোটির ভেতর মাচা বা চৌকিতে নারী-শিশু ও বৃদ্ধ লোকজন শুয়ে গড়াগড়ি খাচ্ছে। কোনোটি অনেকটাই খোলা। নারী-পুরুষ বসে কথাবার্তা বলে সময় পার করছেন। আবার নতুন করেও এ রকম অনেকগুলো ঘর তৈরি করা হচ্ছে। সবার চোখেমুখে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা। 

এই চেহারাটি মৌলভীবাজার-সিলেট আঞ্চলিক মহাসড়কের মৌলভীবাজার সদর উপজেলার খলিলপুর ইউনিয়নের শেরপুর এলাকার হামরকোনা, ব্রাহ্মণগাঁও এলাকায়। মহাসড়কের দুপাশে এ রকম অনেকগুলো অস্থায়ী আবাসে ঠাঁই নিয়েছে বানভাসি মানুষ।

গতকাল মঙ্গলবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত এলাকাটি ঘুরে দেখা গেছে, অনেকেই ঘরবাড়ি ছেড়ে আশ্রয়কেন্দ্র, প্রতিবেশীর উঁচু বাড়িতে, না হয় রাস্তার পাশে অস্থায়ী ডেরা নির্মাণ করে আশ্রয় নিয়েছে। নতুন করে অনেকে বাঁশ ও পলিথিন দিয়ে সড়কের পাশে আশ্রয়স্থল তৈরি করছে।

বানভাসি মানুষ হামরকোনা গ্রামের জিলু মিয়া বলেন, ‘বাড়ির সামনে রাস্তা ভাঙছে। ঘরবাড়ি ভাসাই নিছেগি (ভাসিয়ে নিয়েছি)। পাশের এক বাড়িত আশ্রয় নিছি (নিয়েছি)।’ একই গ্রামের আফি বেগম বলেন, ‘আমরার ঘরও পানি। মাচাঙ (মাচা) করি আছি। গরু-বাছুর লইয়া বিপদে। না গরুয়ে খাইতো পারের (খেতে পারছে)। না মাইনষর রান্না করতাম পাররাম।’

প্রশাসন ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, কুশিয়ারা নদীতে পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় নদীর পাড় উপচে সদর উপজেলার খলিলপুর ইউনিয়নের হামরকোনা, দাউদপুর, ব্রাহ্মণগাঁও, চানপুর ও নতুন বস্তি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। গত শনিবার সন্ধ্যার দিকে নদীর পাড় উপচে আসা পানিতে হামরকোনা গ্রামের পাকা রাস্তার দুটি স্থান ভেঙে যায়। ফলে এলাকার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়ে।

সদর উপজেলার ইউএনও মো. মনিরুজ্জামান বলেন, ‘কুশিয়ারা ও মনু নদের পানি বাড়ছে। নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। নিয়মিত ত্রাণ তৎপরতা অব্যাহত রাখছি।’

কমলগঞ্জ : গত ২৪ ঘণ্টায় তেমন বৃষ্টি না হওয়ায় নদ ও ছড়ার পানি কিছুটা কমায় মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জের নিম্নাঞ্চলের শমশেরনগর, পতনউষার ও মুন্সীবাজার এলাকায় বন্যার পানি নামতে শুরু করেছে। তবে হতদরিদ্র পানিবন্দী শত শত পরিবারের মধ্যে এখন পর্যন্ত কোনো ত্রাণ পৌঁছায়নি।

ইউএনও আশেকুল হক বলেন, এ পর্যন্ত ৬২ মেট্রিক টন চালের মধ্যে ৫২ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ করা হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের জন্য ১ লাখ টাকা বরাদ্দ করা হবে। আরও ১০ মেট্রিক টন চাল পর্যায়ক্রমে দেওয়া হবে।

সুনামগঞ্জ : সুনামগঞ্জ পৌর শহরের কাছে সুরমা নদীর পানি গতকাল বেলা তিনটায় বিপৎসীমার ৬৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। সোমবার একই সময় পানি বিপৎসীমার ৭৯ সেন্টিমিটার ওপরে ছিল। 

জেলা প্রশাসনের হিসাব অনুযায়ী, জেলায় বন্যাকবলিত মানুষের সংখ্যা ১ লাখ ২০ হাজার। ২২টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। ইতিমধ্যে জেলার উপজেলাগুলোতে ৩৮৫ মেট্রিক টন চাল, ৯ লাখ ৮০ হাজার টাকা এবং ৭ হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।

স্থানীয় প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জেলার সদর, তাহিরপুর, বিশ্বম্ভরপুর, দোয়ারাবাজার ও জামালগঞ্জ উপজেলা এক সপ্তাহ ধরে বন্যাকবলিত। এসব উপজেলার বেশির ভাগ গ্রামের মানুষই আক্রান্ত হয়েছে। তিন দিন ধরে ছাতক, দক্ষিণ সুনামগঞ্জ, জগন্নাথপুর, দিরাই ও শাল্লা উপজেলায় পানি বেড়ে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে।

সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক (ভারপ্রাপ্ত) মোহাম্মদ শরীফুল ইসলাম বলেছেন, পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে। বৃষ্টি না হলে আরও উন্নতি হবে। জেলা ও উপজেলা প্রশাসন, স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সমন্বয়ে ত্রাণ তৎপরতা অব্যাহত আছে।

ধরমপাশা : সুনামগঞ্জের ধরমপাশায় পানি কমলেও মানুষের দুর্ভোগ কমেনি। বন্যার কারণে গতকাল পর্যন্ত উপজেলার ১১০টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাঠদান বন্ধ রয়েছে। উপজেলার বেশির ভাগ সড়ক বন্যার পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় জন ও যান চলাচল এখনো স্বাভাবিক হয়নি। উপজেলা পরিষদের পক্ষ থেকে এ পর্যন্ত ১ হাজার ২০০টি ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের মধ্যে ত্রাণ বিতরণ করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন ইউএনও মোহাম্মদ ওবায়দুর রহমান।

জগন্নাথপুর : সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুরে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। অব্যাহত বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে উপজেলার নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। গতকাল উপজেলার ভবেরবাজার-কাঁঠালখাই-নয়াবন্দর সড়কের বিভিন্ন স্থানে পানি উঠে তলিয়ে যাওয়ায় যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। বন্যাকবলিত হয়ে উপজেলার ৫১টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সাময়িকভাবে বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। 

দায়িত্বপ্রাপ্ত উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইয়াসির আরাফাত বলেন, উপজেলার ৮টি ইউনিয়নের মধ্যে ৫টিতে মানুষ পানিবন্দী আছেন। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ৬০ মেট্রিক টন চাল ও ৭৫০ প্যাকেট শুকনো খাবারের প্যাকেট পাওয়া গেছে। 

নবীগঞ্জ : হবিগঞ্জের নবীগঞ্জ উপজেলার তিনটি ইউনিয়নের প্রায় ৫০টি গ্রাম বন্যার পানিতে তলিয়ে আছে। এ কারণে উপজেলার ১৬টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, রোববার রাত সাড়ে ১১টার দিকে কুশিয়ারা নদীর প্রতিরক্ষা বাঁধের নবীগঞ্জ উপজেলার জামারগাঁও জামে মসজিদের কাছে ভাঙন দেখা দেয়। এতে প্রায় ৫০টি গ্রামের ২৫ হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। তলিয়ে গেছে হাওরের প্রায় ১০ হাজার একর ফসলি জমি। বিবিয়ানা পাওয়ার প্ল্যান্টেও পানি প্রবেশ করেছে। 

উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা কাজী সাইফুল ইসলাম বলেন, রাস্তাঘাট ডুবে থাকায় শিক্ষার্থীরা স্কুলে আসছে না। প্রশাসনিক সিন্ধান্তে স্কুলগেুলো বন্ধ ঘোষণা করা হয়।

[প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়েছেন নিজস্ব প্রতিবেদক, মৌলভীবাজার ও সুনামগঞ্জ, প্রতিনিধি, কমলগঞ্জ, ধরমপাশা, জগন্নাথপুর ও হবিগঞ্জ]