ডেঙ্গুতে রক্তের চাহিদা বেড়েছে

রেড ক্রিসেন্ট রক্ত কেন্দ্রের প্রধান কার্যালয় রাজধানীর মোহাম্মদপুরে ৭/৫ আওরঙ্গজেব সড়কে। মানুষ এই কেন্দ্রে আসে রক্তের প্রয়োজনে। গতকাল শুক্রবার মোটরগাড়ির মেরামতকারী (ম্যাকানিক) নূর মোহাম্মদ ওই কেন্দ্রে এসেছিলেন রক্তের প্লাটিলেট (অণুচক্রিকা) সংগ্রহের জন্য। প্লাটিলেট রক্তের একটি উপাদান।

নূর মোহাম্মদের মা বেনু বেগম ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত। তিন দিন ধরে তিনি আল মানারত নামের একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি আছেন। বৃহস্পতিবার রাতে চিকিৎসকেরা বলেছিলেন, বেনু বেগমকে জরুরিভাবে প্লাটিলেট দিতে হবে।

গতকাল দুপুরে রেড ক্রিসেন্টের ওই কেন্দ্রে একটি বেঞ্চে ম্লান মুখে বসে ছিলেন নূর মোহাম্মদ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর মায়ের রক্তের গ্রুপ বি–পজিটিভ। এক ব্যাগ প্লাটিলেট মায়ের শরীরে দিতে হবে। এর জন্য চারজন রক্তদাতা প্রয়োজন। পরিচিতের মধ্যে একজন দাতা পাওয়া গেছে। কী করবেন ঠিক বুঝতে পারছেন না।

একই জায়গায় কথা হয় রণজিৎ চক্রবর্তীর সঙ্গে। তাঁর সাত বছরের ছেলে উৎসব চক্রবর্তী ডেঙ্গুতে আক্রান্ত। লালমাটিয়ার শিশু ও নবজাতক জেনারেল হাসপাতালে তার চিকিৎসা চলছে। তারও এক ব্যাগ প্লাটিলেট প্রয়োজন।

কেন্দ্রের কর্মরত নার্স ও মেডিকেল টেকনোলজিস্ট বললেন, গত কিছুদিন প্লাটিলেটের জন্য কেন্দ্রে মানুষের চাপ বেড়েছে। ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্লাটিলেটের চাহিদাও বেড়েছে।

এক মাইক্রোলিটার রক্তে সাড়ে তিন লাখ থেকে সাড়ে চার লাখ প্লাটিলেট বা অণুচক্রিকা থাকে। সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক মাহমুদুর রহমান বলেন, ডেঙ্গু ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তির রক্তে প্লাটিলেট কমে যায়। প্লাটিলেট কমে গেলে রক্তক্ষরণ হয়। রক্তক্ষরণে মানুষ মারাও যেতে পারে। প্লাটিলেট ২০ হাজার কম হলে রোগীকে বাড়তি প্লাটিলেট দিতে হয়।

ওই কেন্দ্রের মেডিকেল টেকনোলজিস্ট শর্মী খান বলেন, এক ব্যাগ প্লাটিলেটের জন্য চার ব্যাগ রক্তের প্রয়োজন হয়। এ জন্য দরকার চারজন দাতা। এতে খরচ পড়ে সাড়ে চার হাজা
র টাকা। অ্যাফ্রেসিস পদ্ধতিতে একজন দাতার শরীর থেকে সরাসরি এক ব্যাগ শুধু প্লাটিলেট নেওয়া যায়। তাতে খরচ পড়ে ১৫ হাজার টাকা।

আরও দুটি রক্তকেন্দ্রে যোগাযোগ করে জানা গেছে, ডেঙ্গুর কারণে রক্তকেন্দ্রে চাপ বেড়েছে। হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট হাসপাতালের রক্ত কেন্দ্রের মেডিকেল টেকনোলজিস্ট মাসুম রেজা বলেন, ‘অন্য সময়ে দিনে আমাদের ৭/৮ ব্যাগ প্লাটিলেট সরবরাহ করতে হতো। এখন করতে হচ্ছে ৭০ থেকে ৮০ ব্যাগ। ডেঙ্গুর কারণে আমাদের ওপর কাজের চাপ বেড়েছে ১০ থেকে ১৫ গুণ।’ তিনি জানান, গত বৃহস্পতিবার অ্যাফ্রেসিস পদ্ধতিতে ১১ ব্যাগ প্লাটিলেট সরবরাহ করা হয়েছে। অন্য সময় হয়তো দিনে মাত্র এক ব্যাগের ব্যবস্থা করতে হতো।

প্লাটিলেটের চাহিদা ব্যাপক বেড়েছে বলে জানিয়েছেন কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের সমন্বয়কারী শেখ মোহাম্মদ ফয়সাল। অন্য সময় দিনে তাঁরা ২০ থেকে ২৫ ব্যাগ বা ইউনিট প্লাটিলেট সরবরাহ করতেন। ডেঙ্গুর কারণে তা বেড়ে ৬০ থেকে ৬৫ ব্যাগে দাঁড়িয়েছে।

জরুরি প্রয়োজনে পরিবারের সদস্য ও আত্মীয়ের কাছ থেকেই রক্ত পাওয়া যায়। সরকারি পরিসংখ্যান বলছে, চিকিৎসার সময় ৭০ শতাংশ ক্ষেত্রে রক্ত দান করেন নিকটজন। ৩০ শতাংশ রক্ত পাওয়া যায় স্বেচ্ছায় রক্তদাতাদের কাছ থেকে।

সরকারের পক্ষে রক্ত পরিসঞ্চালনার কাজ তত্ত্বাবধান করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হাসপাতাল সেবা বিভাগের নিরাপদ রক্ত পরিসঞ্চালন ও থ্যালাসেমিয়া ব্যবস্থাপনা কর্মসূচি। এ কর্মসূচির উপব্যবস্থাপক সব্যসাচী নাথ প্রথম আলোকে বলেন, ডেঙ্গুর কারণে প্লাটিলেটের চাহিদা বেড়েছে ঠিকই, তবে প্লাটিলেট না পেয়ে কেউ অসুবিধায় পড়েছেন এমন খবর পাওয়া যায়নি। প্রয়োজনে সন্ধানী, মেডিসিন ক্লাব, বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি, বাঁধন, থ্যালাসেমিয়া ফাউন্ডেশন, থ্যালাসেমিয়া সমিতি ও কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনে যোগাযোগ করার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিয়ন্ত্রণকক্ষের হিসাবে গতকাল বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে ১ হাজার ১৭৪ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি ছিল। আর এ পর্যন্ত চিকিৎসা নিয়ে হাসপাতাল ছেড়েছে ৪ হাজার ৪৩৮ জন। প্রথম আলোর অনুসন্ধানে দেখা গেছে, এ বছর ডেঙ্গুতে ২২ জনের মৃত্যু হয়েছে।