'হাড্ডিগুড্ডি বাইর অই গেইয়ি'

টানা বর্ষণে ক্ষতবিক্ষত হয়ে পড়েছে চট্টগ্রাম নগরের সড়কগুলো। সৃষ্টি হয়েছে ছোট-বড় খানাখন্দ। দুর্ভোগ ও ঝুঁকিতে যাত্রী ও চালকেরা। গত বুধবার চট্টগ্রাম নগরের পোর্ট কানেকটিং (পিসি) রোডের নয়াবাজার এলাকায়।  ছবি: সৌরভ দাশ
টানা বর্ষণে ক্ষতবিক্ষত হয়ে পড়েছে চট্টগ্রাম নগরের সড়কগুলো। সৃষ্টি হয়েছে ছোট-বড় খানাখন্দ। দুর্ভোগ ও ঝুঁকিতে যাত্রী ও চালকেরা। গত বুধবার চট্টগ্রাম নগরের পোর্ট কানেকটিং (পিসি) রোডের নয়াবাজার এলাকায়। ছবি: সৌরভ দাশ

চট্টগ্রাম নগরের পিসি রোডে নিয়মিত বাস চালান হাকিম আলী। কিছুদিন ধরে টানা বৃষ্টিতে ছোট-বড় খানাখন্দে ভরে গেছে সড়কগুলো। হাকিম আলী তাই বিরক্ত। ক্ষোভ ঝেড়ে বললেন, ‘রাস্তা বেয়াগগুনুর হাড্ডিগুড্ডি বাইর অই গেইয়ি। গাড়ি চালাইতে জান বাইর অই যার।’ (বেশির ভাগ রাস্তার হাড়গোর বের হয়ে গেছে। গাড়ি চালাতে প্রাণ বেরিয়ে আসে।)

শুধু বাসচালক হাকিম আলী নন, নগরের রাস্তায় বের হলে সবাই এভাবে বিরক্তি প্রকাশ করছেন। অথচ সড়কগুলোর উন্নয়ন ও রক্ষণাবেক্ষণ খাতে প্রতিবছর ব্যয় বাড়িয়ে চলেছে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন। গত ৯ অর্থবছরে এই খাতে ব্যয় হয়েছে দেড় হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ প্রতিবছরে গড়ে এর পরিমাণ ১৬৬ কোটি ৬৬ লাখ টাকা। বরাদ্দ বাড়লেও বেহাল সড়কের দুর্ভোগ থেকে মুক্তি পাচ্ছে না নগরবাসী।

করপোরেশনের সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, নগরে বর্তমানে ১ হাজার ১০৪ কিলোমিটার সড়ক রয়েছে। এর মধ্যে পিচঢালা সড়ক ৭৪৪ কিলোমিটার। এবার বৃষ্টিতে প্রায় দুই শ কিলোমিটার সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বছরে শতকোটি টাকা ব্যয়ের পরও নগরের সড়কগুলোর এ অবস্থার জন্য কাজের নিম্নমান ও জবাবদিহির অভাবকে দায়ী করেছেন বিশেষজ্ঞরা।

পরিকল্পিত চট্টগ্রাম ফোরামের সহসভাপতি ও সড়ক পরিবহন বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী সুভাষ বড়ুয়া প্রথম আলোকে বলেন, ঠিকভাবে কাজ করলে একটি সড়ক অন্তত পাঁচ থেকে সাত বছর অক্ষত থাকার কথা। তাঁর ভাষ্য, সড়ক কেন খারাপ হচ্ছে, এ জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের জবাবদিহির আওতায় অবশ্যই আনতে হবে। না হলে প্রতিবছর টাকা খরচ হবে। কিন্তু দুর্ভোগ থেকে যাবে।

দাতা সংস্থা জাইকা ও সিটি করপোরেশনের নিজস্ব প্রতিবেদনেও নগরের সড়কগুলো সংস্কার, উন্নয়নে নিম্নমানের উপকরণ ও গুণগত মান বজায় না রাখার বিষয়টি বিভিন্ন সময়ে উঠে এসেছে।

নিম্নমানের কাজের কারণে সড়কের মান খারাপ হচ্ছে, তা আংশিকভাবে স্বীকার করেছেন সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী লেফটেন্যান্ট কর্নেল মহিউদ্দিন আহমদ। অবশ্য তাঁর দাবি, পানির পাইপ স্থাপনে ওয়াসার খোঁড়াখুঁড়ি, পণ্যবাহী ভারী যান চলাচল, জলাবদ্ধতাসহ বিভিন্ন কারণে সংস্কারের পরও সড়কগুলো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তাই সেবা সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয় এবং বিআরটিএ ও ট্রাফিক বিভাগের কার্যকর ভূমিকা ছাড়া এ অবস্থা থেকে উত্তরণ সম্ভব না।

পণ্য পরিবহনে বাড়ছে ব্যয়

সড়কের এই ক্ষতির প্রভাব শুধু নগরেই সীমাবদ্ধ নয়। কেননা চট্টগ্রাম বন্দর থেকে সারা দেশে পণ্য আনা–নেওয়ার জন্য নগরের সড়কগুলো ব্যবহৃত হয়। ফলে এই সড়কগুলো ভাঙা থাকলে পণ্য পরিবহনে সময় ও ভাড়া বেশি লাগে। আর এই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেন ব্যবসায়ীরা। যা শেষ পর্যন্ত সাধারণ মানুষকেই বহন করতে হয়।

>

চট্টগ্রামে সড়ক বেহাল
প্রায় দুই শ কিলোমিটার সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত
সংস্কারের এক বছরেই ভেঙে চুরমার

চট্টগ্রাম চেম্বারের সভাপতি মাহবুবুল আলম মনে করেন, রাস্তাঘাট নষ্ট হওয়ায় ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে সাধারণ জনগণ—সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘বেহাল রাস্তার কারণে একটি গাড়ি গন্তব্যে পৌঁছাতে বাড়তি সময় লাগে। ফলে গাড়িভাড়া বেড়ে যাচ্ছে। স্বাভাবিকভাবে পণ্যের দাম বাড়বে। আর এর মূল্য দিতে হচ্ছে সাধারণ মানুষ তথা ভোক্তাকে।’

সংস্কারের পরও বারবার ক্ষতিগ্রস্ত

সিটি করপোরেশনের বিভিন্ন নথিপত্র পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ২০১৭ সালে ভারী বর্ষণে ক্ষতিগ্রস্ত উল্লেখযোগ্য সড়কগুলো ছিল পোর্ট কানেকটিং রোড, আগ্রাবাদ এক্সেস রোড, ডিটি রোড, স্ট্র্যান্ড রোড, শেখ মুজিব সড়ক, সিডিএ অ্যাভিনিউ, আরাকান সড়ক, হাটহাজারী সড়ক, বায়েজিদ বোস্তামী সড়ক, কাপাসগোলা সড়ক, ফিরিঙ্গিবাজার মেরিনার্স সড়ক, জুবিলি রোড, খাজা সড়ক ও মিয়া খান সড়ক।

সড়ক পরিবহন বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী সুভাষ বড়ুয়া মনে করেন, সড়কগুলো সংস্কার ও উন্নয়নে গুণগত কাজ হয় না। নিম্নমানের উপকরণসামগ্রীর ব্যবহার তো আছেই। ফলে সংস্কারের বছরখানেকের মধ্যেই রাস্তা ভেঙে যাচ্ছে।