ছেলেধরা আতঙ্কে গণপিটুনিতে নিহত ৩

ছবিটি প্রতীকী
ছবিটি প্রতীকী

ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনিতে রাজধানীসহ সারা দেশে তিনজন নিহত হয়েছেন। এ ছাড়া চার নারীসহ আহত হয়েছেন পাঁচজন। রাজধানীর উত্তর বাড্ডা ও কেরানীগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ, গাজীপুরের চান্দনা, চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড এবং ময়মনসিংহের ভালুকায় এসব ঘটনা ঘটেছে।

আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর:

উত্তর বাড্ডা: আজ শনিবার সকালে রাজধানীর উত্তর বাড্ডা এলাকায় ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনিতে এক নারীর মৃত্যু হয়েছে। সকাল নয়টার দিকে উত্তর বাড্ডা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে এ ঘটনা ঘটে। বাড্ডা থানা-পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, সকাল সাড়ে আটটার দিকে একজন নারী উত্তর-পূর্ব বাড্ডা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যাচ্ছিলেন। এ সময় স্কুলের সামনে প্রবেশপথে থাকা অভিভাবকেরা তাঁকে ভেতরে যাওয়ার কারণ জানতে চান। ওই নারী সন্তানকে স্কুলে ভর্তি করাবেন বলে জানান। স্কুলে শিক্ষার্থী ভর্তি নেওয়া হচ্ছে না—জানিয়ে ওই নারীকে প্রধান শিক্ষিকার কক্ষে নেন তাঁরা। এ সময় চারপাশে খবর ছড়িয়ে পড়ে যে স্কুলে ছেলেধরা এসেছে। এ খবরে স্কুলে লোকজন ভিড় জমায়। এর কিছুক্ষণ পরই ছেলেধরা সন্দেহে স্কুলের বাইরে এনে ওই নারীকে মারধর করা হয়। পুলিশ ওই নারীকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পর চিকিৎসকেরা তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন।

বাড্ডা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ঘটনাটি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তবে নারীর নাম-পরিচয় এখন পর্যন্ত জানা যায়নি। ওই নারীর বয়স আনুমানিক ৩৩ থেকে ৩৪ বছর হতে পারে বলে ধারণা করছেন তিনি।

সিদ্ধিরগঞ্জ: আজ সকালে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে পৃথক ঘটনায় ছেলেধরা সন্দেহে স্থানীয় লোকজনের পিটুনিতে অজ্ঞাত এক যুবক (২৫) এবং শারমিন আক্তার (২০) নামের এক নারী গুরুতর আহত হয়েছেন। প্রত্যক্ষদর্শী ও সিদ্ধিরগঞ্জ থানা-পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, আজ সকাল ৮টার দিকে সিদ্ধিরগঞ্জের মিজমিজি আল আমিন নগর এলাকায় আইডিয়াল ইসলামিয়া স্কুলের প্লে শ্রেণির ছাত্রী সাত বছর বয়সী সাদিয়া স্কুলে যাচ্ছিল। পথে অজ্ঞাত ওই যুবক সাদিয়াকে তুলে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। শিশুটি তখন কান্নাকাটি শুরু করলে ছেলেধরা সন্দেহে এলাকার লোকজন যুবকটিকে আটক করে। জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে অসংলগ্ন কথাবার্তা বলতে শুরু করেন তিনি। তখন এলাকার লোকজন জড়ো হয়ে যুবকটিকে পিটুনি দেয়। খবর পেয়ে সিদ্ধিরগঞ্জ থানা-পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে ওই যুবককে উদ্ধার করে শহরের খানপুরে তিন শ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসকেরা তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন।

সাদিয়ার বাবা সোহেল মিয়া সাংবাদিকদের বলেন, তার মেয়েকে ওই যুবক কাঁধে করে তুলে নিয়ে যাচ্ছিলেন। মেয়ের কান্না শুনে এলাকাবাসী সন্দেহ করে ওই যুবককে আটকায়। এ সময় গণপিটুনির শিকার হন ওই যুবক।

এদিকে বেলা সাড়ে ১১টার দিকে একই উপজেলার পাইনাদি নতুন মহল্লা এলাকায় সন্দেহজনকভাবে ঘোরাফেরা করতে থাকেন শারমিন আক্তার (২০) নামের এক নারী। পরিচয় জিজ্ঞেস করার পর ঠিকঠাক উত্তর দিতে না পারায় ছেলেধরা সন্দেহে এলাকার লোকজন তাঁকে পিটুনি দেয়। পরে পাশের একটি স্কুলের ভেতর নিয়ে গিয়ে তাঁকে প্রাণে বাঁচানো হয়। পুলিশ গিয়ে তাঁকে রক্তাক্ত অবস্থায় উদ্ধার করে শহরের খানপুরে তিন শ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালে ভর্তি করে।

জানতে চাইলে নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সুবাস চন্দ্র সাহা প্রথম আলোকে বলেন, ছেলেধরা সন্দেহে এসব গণপিটুনির ঘটনা ঘটছে। আহত ওই নারীর পরিবার জানিয়েছে, তিনি মানসিক রোগী। বিষয়টি তদন্ত করে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

কেরানীগঞ্জ: ঢাকার কেরানীগঞ্জের হজরতপুর ইউনিয়নের রসুলপুর গ্রামে গতকাল শুক্রবার রাত সাড়ে আটটার দিকে ছেলেধরা সন্দেহে অজ্ঞাতপরিচয় দুই যুবককে গণপিটুনি দেওয়া হয়। এ ঘটনায় একজনের মৃত্যু হয়েছে। অপরজনকে গুরুতর আহত অবস্থায় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়েছে। কেরানীগঞ্জ মডেল থানা-পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, গতকাল সন্ধ্যায় রসুলপুর গ্রামে শরীফ মিয়ার বাড়ির সামনে দুই যুবক ঘোরাফেরা করতে থাকেন। এলাকাবাসীর সন্দেহ হলে তাদের ঘোরাফেরার কারণ জিজ্ঞাসা করা হয়। দুই যুবক ঠিকঠাক উত্তর দিতে না পারায় এলাকাবাসী ক্ষিপ্ত হয়ে দুই যুবককে পিটুনি দেয়। খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে রাত সাড়ে ৯টার দিকে আহত এক যুবককে উদ্ধার করে চিকিৎসার জন্য উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যায়। অপরজনের অবস্থা গুরুতর হওয়ায় তাঁকে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। দায়িত্বরত চিকিৎসক তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন।

কেরানীগঞ্জ মডেল থানার কলাতিয়া পুলিশ ফাঁড়ির পরিদর্শক (ওসি) মোহাম্মদ শাহ আলম বলেন, দুই যুবকের শরীরে কিলঘুষির চিহ্ন আছে। ময়নাতদন্তের জন্য লাশ স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতাল মর্গে পাঠানো হয়েছে। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসাধীন আহত যুবকের অবস্থা আশঙ্কাজনক। অজ্ঞাত দুই যুবক ছেলেধরা চক্রের সদস্য হতে পারে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে। এ ঘটনায় কেরানীগঞ্জ মডেল থানায় একটি মামলা প্রক্রিয়াধীন আছে।

সীতাকুণ্ড: চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে ছেলেধরা সন্দেহে রেহেনা বেগম (৪৫) নামের এক নারীকে আটক করে পুলিশে দিয়েছে স্থানীয়রা। শনিবার সকাল সাড়ে নয়টার দিকে উপজেলার সলিমপুর ইউনিয়নের পুরাতন দাইয়াবাড়ি থেকে আটক করে স্থানীয়রা। স্থানীয়দের বরাত দিয়ে ফৌজদারহাট পুলিশ ফাঁড়ির ট্রাফিক পরিদর্শক (টিআই) রফিক আহমেদ মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, শনিবার সকালে আরফাতুল ইসলাম সিফাত নামে পাঁচ বছরের এক শিশু ঘরের বাইরে খেলছিল। এ সময় ওই নারী শিশুটিকে কোলে তুলে নিয়ে পালানোর চেষ্টা করেন। চিৎকার শুনে ঘর থেকে বের হয়ে মা পারুল আক্তার চিৎকার শুরু করেন। পরে তাঁকে আটক করে পুলিশের হাতে হস্তান্তর করা হয়।

সীতাকুণ্ড থানার পরিদর্শক (তদন্ত) শামীম শেখ বলেন, ওই নারীকে হাটহাজারী কাঁচা বাজারের কাছে দীর্ঘদিন ধরে পাগল বেশে ঘুরতে দেখা গেছে। সম্ভবত ওই নারী মানসিকভাবে ভারসাম্যহীন। তবুও বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

গাজীপুর : গাজীপুরের চান্দনা চৌরাস্তা এলাকায় ছেলে ধরা সন্দেহে মমতাজ খাতুন (৪৫) নামে এক নারীকে গণপিটুনি দিয়ে পুলিশে সোপর্দ করা হয়েছে। গুরুতর আহত ওই নারীকে শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। পুলিশের দাবি, গণপিটুনির শিকার ওই নারী মানসিক ভারসাম্যহীন। গাজীপুর মহানগরের বাসন থানার ওসি একেএম কাউসার জানান, শনিবার সকাল সাড়ে সাতটার দিকে চান্দনা চৌরাস্তা এলাকায় রাস্তায় ওই নারীকে সন্দেহজনকভাবে ঘোরাঘুরি করতে দেখা যায়। একপর্যায়ে ওই নারী রাস্তার পাশে এক দম্পতির শিশুকে আদর করতে গেলে তাঁরা তাকে আটক করেন। পরে স্থানীয়রা তাঁকে ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনি দিয়ে পুলিশে সোপর্দ করা হয়। গুরুতর আহত অবস্থায় উদ্ধার করে পুলিশ মমতাজ খাতুনকে শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করে।

ভালুকা: ময়মনসিংহের ভালুকা উপজেলায় গলাকাটায় জড়িত সন্দেহে এক নারীকে পিটিয়ে জখম করা হয়েছে। শনিবার বেলা সাড়ে ১১ টার দিকে ওই নারীকে উদ্ধার করে ভালুকা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করেছে ভালুকা মডেল থানা-পুলিশ। আহত নারীর নাম মালেকা খাতুন(৩৫)।

প্রত্যক্ষদর্শী ও পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, একটি কারখানার শ্রমিকের মেসে রান্নার কাজ করেন মালেকা খাতুন। শনিবার সকালে ব্যাগ নিয়ে বাড়ি ফিরছিলেন তিনি। উপজেলার ধামশুর এলাকায় পৌঁছালে এক ব্যক্তি ব্যাগের মধ্যে কী আছে বলে জিজ্ঞেস করেন। সন্দেহ হলে ওই ব্যক্তি ব্যাগ খুলে দেখতে চান। এতে মালেকা বাধা দিলে ওই ব্যক্তি ঘাড় কাটা, ঘাড় কাটা বলে চিৎকার শুরু করেন। পরে আশপাশের লোকজন মালেকাকে মারধর শুরু করেন। একপর্যায়ে তাঁকে হাত-পা বেঁধে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশে ফেলে রাখা হয়।

ভালুকা মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা(ওসি) মাইন উদ্দিন জানান, বিষয়টি জানার সঙ্গে সঙ্গে ঘটনাস্থলে পুলিশ পাঠানো হয়। পরে ওই নারীকে উদ্ধার করে ভালুকা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়েছে। মূলত নারীর কথা বলার ভাষার কারণে ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে। এ ছাড়া মিথ্যা গুজব ছড়িয়ে ঘটনাটি বড় করা হয়েছে বলেও জানান তিনি।