বাঁধভাঙা পানিতে ভাসছে সোনাতলা

সোনাতলার চরপাড়া–পাকুল্লা সড়ক। ছবি: সোয়েল রানা
সোনাতলার চরপাড়া–পাকুল্লা সড়ক। ছবি: সোয়েল রানা

ঘরের ভেতরে কোমরপানি। উঠানে পানির স্রোত। পাকা সড়কে বইছে পানির ধারা। কয়েকটি সড়কে পানি উঠে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। পানিবন্দী ৭৭ গ্রামের প্রায় লাখো মানুষ। ইতিমধ্যে ডুবে মারা গেছে শিশু, বৃদ্ধসহ দুজন। তিন দিন ধরে এ চিত্র বগুড়ার সোনাতলা উপজেলায়।

১৫ জুলাই উজানে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ভেঙে যমুনা, ঘাঘট ও করতোয়া (উজান করতোয়া) নদীর পানি ঢুকে পড়ে লোকালয়ে। তলিয়ে গেছে কৃষকের খেতের ফসল। ভেসে গেছে পুকুরের মাছ।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী হাসান মাহমুদ প্রথম আলোকে বলেন, সপ্তাহখানেক আগে উজানে গাইবান্ধায় ১৮টি স্থানে বাঁধ ভেঙে যমুনা, ঘাঘট ও উজান করতোয়া নদীর পানি লোকালয়ে ঢুকে পড়ে। এতে বাঙ্গালী নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে আজ বুধবার দুপুর ১২টায় বিপৎসীমার ১০০ দশমিক ৭০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে।

আজ সকাল দশটার দিকে উপজেলার জোড়গাছা ইউনিয়নের স্বজনেরপাড়া, চরপাড়াসহ বেশ কিছু গ্রাম ঘুরে দেখা গেছে, বাড়িঘরগুলোর কোথাও হাঁটু আবার কোথাও কোমরপানি। স্বজনেরপাড়ায় পাকুল্যা-বগুড়া সড়কে হাঁটুপানির স্রোত বইছে। এতে করে ট্রাক, পিকআপ, অটোরিকশা, ভ্যানসহ সব ধরনের যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। সড়কে যান চলাচল বন্ধ হওয়ায় মানুষের দুর্ভোগ চরম পোহাতে হচ্ছে। বিশেষ করে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করতে হচ্ছে।

পানিতে দাঁড়িয়েই রান্না করছেন তেকানি গ্রামের শাহানা বেওয়া। ছবি: সোয়েল রানা
পানিতে দাঁড়িয়েই রান্না করছেন তেকানি গ্রামের শাহানা বেওয়া। ছবি: সোয়েল রানা

পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় যান চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে হুয়াকুয়া-হাসরাজ-হরিখালি সড়কও।

হুয়াকুয়া গ্রামের আজগর আলী বলেন, গত দুই যুগে এ গ্রামে বন্যার পানি ঢোকেনি। কিন্ত বাঙ্গালীর ঢলে আকস্মিক বন্যায় বসতঘরে কোমরপানি। রান্না বন্ধ। পানির নিচে তলিয়ে গেছে খেতের পাট, সবজি, আউশ ধানসহ নানা ফসল। প্রস্তুতি না থাকায় মানুষজন দিশেহারা হয়ে পড়েছে।
সৈয়দ আহমেদ কলেজের শিক্ষার্থী সিহাব আহমেদ বলেন, ‘সাইকেল নিয়ে কলেজে যাতায়াত করতাম। এখন হেঁটে পারাপার হতেও বুকটা দুরু দুরু করছে।’

সোনাতলা উপজেলায় পানিতে ডুবে মারা গেছে দুজন। এর মধ্য মকবুল হোসেন (৮০) গত সোমবার বাড়ি থেকে আড়িয়াঘাট বাজারে দুধ বিক্রি করার জন্য যাওয়ার পথে পা পিছলে পড়ে গেলে স্রোতের তোড়ে ভেসে যান। এতে তাঁর মৃত্যুঘটে। তাঁর বাড়ি সোনাতলা সদর উপজেলার আড়িয়া চকনন্দন গ্রামে।
অন্যদিকে একই দিন উপজেলার কামারপাড়া গ্রামে পানিবন্দী বসতবাড়িতে খড়ের গাদার ওপর বসে খেলছিল রুস্তম আলীর দুই বছরের শিশু সৈকত বাবু। অসাবধানতাবশত পানিতে পড়ে গেলে শিশুটির মৃত্যু হয়।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শফিকুর আলম বন্যাদুর্গত এলাকায় পানিতে ডুবে দুজনের মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, সরকারি হিসাবে আজ বুধবার পর্যন্ত উপজেলার সাতটি ইউনিয়ন এবং একটি পৌরসভার ১৭ হাজার পরিবারের বসতঘর কোথাও হাঁটুপানি আবার কোথাও কোমরপানিতে তলিয়ে গেছে। পানিবন্দী হয়ে পড়েছে ৮৭ হাজার মানুষ এবং ২৯ হাজার গবাদিপশু। বন্যার পানিতে শ্রেণিকক্ষ জলমগ্ন হওয়ায় ৩২টি স্কুল-কলেজ এবং ৪৯টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাঠদান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে ৫ হাজার ১৩০ হেক্টর খেতের ফসল। বসতবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে হাজারখানেক। স্রোতের তোড়ে ভেসে গেছে চাষিদের পুকুরের মাছ।

যোগাযোগ বিছিন্ন সোনাতলা-জুমারবাড়ী সড়ক। ছবিটি গোপাই শাহবাজপুর এলাকার। ছবি: সোয়েল রানা
যোগাযোগ বিছিন্ন সোনাতলা-জুমারবাড়ী সড়ক। ছবিটি গোপাই শাহবাজপুর এলাকার। ছবি: সোয়েল রানা

সোনাতলা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. মাসুদ আহমেদ বলেন, মঙ্গলবার পর্যন্ত পাঁচ হাজার হেক্টর ফসল বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। 

মধুপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান অসীম কুমার জৈন প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর ইউনিয়নে ৫ হাজার ৩০০ পরিবারই পানিবন্দী। এর মধ্যে বসতবাড়িতে পানি ঢুকে পড়ায় দুর্ভোগে পড়েছে ৪ হাজার ৫০০ পরিবার। মঙ্গলবার পর্যন্ত দুর্গত মানুষের মধ্যে সোয়া দুই মেট্রিক টন চাল বিতরণ করা হয়েছে।

সোনাতলা উপজেলা প্রশাসন জানিয়েছে, কাল পর্যন্ত দুর্গত মানুষের জন্য ত্রাণসহায়তা হিসেবে ৫০০ প্যাকেট শুকনো খাবার, ২২৫ মেট্রিক টন চাল এবং ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা বরাদ্দ মিলেছে।
এদিকে বাঙ্গালী নদীর পানিতে তলিয়ে গেছে সারিয়াকান্দি উপজেলার হাটশেরপুর ও নারচি ইউনিয়নের বিস্তীর্ণ এলাকা।

জেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা শাখা সূত্রে জানা গেছে, ১৯৭টি গ্রামের ৬৭ হাজার ৯৪৫ পরিবারের ২ লাখ ৩৫ হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে।