বগুড়া ও সিরাজগঞ্জে বন্যায় ৪৪৭ বিদ্যালয় বন্ধ

পানি ওঠায় নওগাঁর মান্দা উপজেলার চকহরি নারায়ণপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাঠদান বন্ধ রয়েছে।  ছবি: প্রথম আলো
পানি ওঠায় নওগাঁর মান্দা উপজেলার চকহরি নারায়ণপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাঠদান বন্ধ রয়েছে। ছবি: প্রথম আলো

যমুনার স্রোতে বিদ্যালয়ের টিনশেড ভবন, শিক্ষা উপকরণ নদীতে চলে গেছে। বিলীন হয়েছে বিদ্যালয়ের জমিও। টিনের কয়েকটি চালসহ আসবাব নৌকায় তুলে শিক্ষকেরা এনে রেখেছেন আধা কিলোমিটার দূরে। এখন শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত শিক্ষক ও অভিভাবকেরা। এ চিত্র বগুড়ার সারিয়াকান্দি উপজেলার চর ফাজিলপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের।

শুধু চর ফাজিলপুর নয়, যমুনার প্রবল ভাঙনে গত এক সপ্তাহে সাতটি বিদ্যালয় ভবন নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। বন্যাকবলিত হয়ে পড়ায় গতকাল বুধবার পর্যন্ত জেলার ১৬৫টি বিদ্যালয়ে পাঠদান কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। এতে প্রায় ৫০ হাজার শিক্ষার্থী বিপাকে পড়েছে। সরকারি হিসাবে এসব বিদ্যালয়ে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ চার কোটি টাকার বেশি।

সিরাজগঞ্জে যমুনায় পানি কমলেও মানুষের দুর্ভোগ কমেনি। নদীভাঙনে এই জেলার তিন উপজেলায় গত কয়েক দিনে সাতটি বিদ্যালয়ের ভবনও বিলীন হয়ে গেছে। বন্যার কারণে বন্ধ রয়েছে ২৮২ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠদান।

বগুড়ার সারিয়াকান্দি উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা রফিকুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, গতকাল পর্যন্ত ৭৯টি বিদ্যালয় নদীভাঙন ও বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এসব বিদ্যালয়ে পাঠদান কার্যক্রমও বন্ধ রয়েছে। এর মধ্যে সাতটি বিদ্যালয়ের জায়গা নদীগর্ভে বিলীন হওয়ায় এগুলো অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। সেগুলো হচ্ছে চর ফাজিলপুর, চর ভাঙ্গুরগাছা, বহলাডাঙ্গা, চর কর্নিবাড়ি, আগ বোহাইল, চকরতিনাথ এবং বিরামের পাঁচগাছি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। সব মিলিয়ে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে প্রায় দুই কোটি টাকার।

 সোনাতলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শফিকুর আলম প্রথম আলোকে বলেন, বন্যার কারণে ৪৯টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ ৮১টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের পাঠদান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। বন্যা দীর্ঘস্থায়ী হলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ অর্ধকোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে।

গতকাল সরেজমিনে দেখা গেছে, এখনো অধিকাংশ চরে কোমরপানি। দুর্গম চরের অধিকাংশ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভবন জলমগ্ন।

নদীগর্ভে বিলীন চর ফাজিলপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের আসবাব এবং ভবনের কিছু টিনের চাল স্তূপ করে রাখা হয়েছে আধা কিলোমিটার দূরে। সেখানেও হাঁটুপানি।

বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক ফরহাদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ১৯৩৭ সালে স্থাপিত বিদ্যালয়টির দ্বিতল ভবন ছিল ফাজিলপুর চরে। ২০১৬ সালে নদীগর্ভে বিলীন হয় ভবনসহ জায়গা। পরে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে নতুন জায়গায় বিদ্যালয়টি সরিয়ে নেওয়া হয়। এক সপ্তাহ আগে যমুনার স্রোতের চাপে বিদ্যালয় ভবন নদীতে চলে যায়।

সারিয়াকান্দি উপজেলার চালুয়াবাড়ি ইউনিয়নে চর ভাঙ্গুরগাছা। একসময় যমুনা নদীর বাম তীরে জেগে ওঠা এই দুর্গম চরে গড়ে উঠেছিল লোকালয়, কয়েক শ পরিবারের বসতি। ১৯৩৫ সালে চর ভাঙ্গুরগাছা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপিত হয়। গত কয়েক বছর যমুনা নদীর ভাঙনে বিলীন হয়ে যাওয়ায় বেশ কয়েকবার আর ভাঙনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বিদ্যালয়টি নদীর ডান তীরের দিকে সরিয়ে নেওয়া হয়। এক সপ্তাহ আগেও ৫০ শতক জায়গার ওপর টিনের বেড়ার ওপর দাঁড়িয়ে ছিল ভাঙ্গুরগাছা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। এখন নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে ভবন। বিদ্যালয় সরিয়ে নেওয়া হয়েছে পাশের সুজনেরপাড়া চরে।

হাটবাড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষে এখনো হাঁটুপানি। এই বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা শতাধিক। তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী শিহাব বলে, বাড়িতে পানি, স্কুলে পানি। দুই সপ্তাহ ধরে বিদ্যালয়ে পাঠদান বন্ধ।

শিমুলতাইর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠ থেকে এখনো পুরোপুরি পানি সরে যায়নি। এই বিদ্যালয়ে দুই সপ্তাহ ধরে বন্ধ রয়েছে পাঠদান।

সহকারী শিক্ষক নিলুধা আকতার বলেন, চারদিকে থইথই পানি। শিশুরা আসতে পারে না। এ জন্য পাঠদান বন্ধ রয়েছে।

সিরাজগঞ্জ জেলা মাধ্যমিক ও প্রাথমিক শিক্ষা কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, বন্যার পানি ওঠায় সিরাজগঞ্জের পাঁচটি উপজেলার ২৮২টি বিদ্যালয়ে পাঠদান বন্ধ রাখা হয়েছে। এর মধ্যে ২১৫টি প্রাথমিক ও ৬৭টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়। বন্যা শুরু হওয়ার পর নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে ছয়টি প্রাথমিক ও একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়।

নদীভাঙনে চৌহালি উপজেলার অ্যাওয়াজী কাঠালিয়া, বিদাশুরিয়া, চৌবারিয়া, বিলজলহর, বেলকুচি উপজেলার রতনকান্দি সোহাগপুর এবং সিরাজগঞ্জ সদরের বেতুয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভবন বিলীন হয়েছে। এ ছাড়া বেলকুচি উপজেলার চরবেল, মেহেরনগর ও শাহজাদপুর উপজেলার বাঐখোলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় নদীভাঙনের হুমকির মুখে রয়েছে। সিরাজগঞ্জ সদরে চারটি, কাজীপুরে সাতটি, বেলকুচিতে দুটি ও চৌহালিতে দুটি বিদ্যালয়ে আশ্রয়কেন্দ্র্র খোলা হয়েছে।

 সিরাজগঞ্জ জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা সিদ্দিক মো. ইউসুফ রেজা জানান, বন্যায় আক্রান্ত ৫টি উপজেলায় ৩৯০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পানি ঢুকেছে। পানিতে বেশি সমস্যা হওয়ায় ২১৫টি প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা হয়েছে। যেসব প্রতিষ্ঠান খোলা রয়েছে, সেসব প্রতিষ্ঠানেও পাঠদানে সমস্যা হচ্ছে।

গতকাল সরেজমিনে দেখা যায়, শাহজাদপুর উপজেলার গোপিনাথপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়েয় দুটি পাকা ভবনের একটিতে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির পাঠদান বন্ধ। তৃতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণির পাঠদান চললেও উপস্থিতি একেবারেই কম। এর মধ্যেই গলাপানি ভেঙে ক্লাস করতে আসছে শিক্ষার্থীরা। কেউবা নৌকায় চড়ে, আবার কেউ আসছে কলাগাছের ভেলায় চেপে। বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী প্রিয়া বলে, ‘এবার ভয়াবহ বন্যায় আমাদের সব তলিয়ে গেছে। স্কুলে না গেলে তো আর লেখাপড়া শেখা যাবে না। তাই কষ্ট করে হলেও পড়তে যাচ্ছি। সামনে পরীক্ষা। তাই আমরা খুবই চিন্তিত।’

বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র হাসিবুলকে কোলে করে পৌঁছে দিতে এসেছেন বাবু মিয়ার স্ত্রী আমিনা খাতুন। বন্যার কারণে ছেলেকে বিদ্যালয়ে নিয়ে আসতে কষ্ট হওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আট দিন ধরে নিজে ভিজে ছেলেকে স্কুলে পৌঁছে দিচ্ছি। সমস্যা হলেও আমার ছেলেকে বড় হতে হবে। এবারের বন্যায় আমরা কোনো ধরনের ত্রাণ সহায়তাও পাইনি। আমাদের বাড়িতেও পানি। ঘরের পানি গতকাল নেমেছে।’

সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার খোকসাবাড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র আবু হাসেম বলেন, ‘আমরা অনেক কষ্ট করে স্কুলে এসেছি,। আমাদের বাড়িঘর পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় আমরা সবাই বড় কষ্টে আছি।’