হেপাটাইটিস বি ঠেকাতে টিকাই মুখ্য

গোলটেবিল বৈঠকে বক্তব্য দেন হেপাটোলজি সোসাইটি, বাংলাদেশের সভাপতি মবিন খান। পাশে এই সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক মো. শাহিনুল আলম। গতকাল কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ে।  ছবি: প্রথম আলো
গোলটেবিল বৈঠকে বক্তব্য দেন হেপাটোলজি সোসাইটি, বাংলাদেশের সভাপতি মবিন খান। পাশে এই সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক মো. শাহিনুল আলম। গতকাল কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ে। ছবি: প্রথম আলো

জন্মের ২৪ ঘণ্টা বা যত দ্রুত সম্ভব হেপাটাইটিস বি আক্রান্ত মায়ের শিশুকে অবশ্যই ইমিউনোগ্লোবিউলিন টিকা দিতে হবে। তবে এ সময়ের মধ্যে সব শিশুকেই হেপাটাইটিস বি-এর টিকা দিতে হবে। এতে পরবর্তী প্রজন্ম হেপাটাইটিস বি মুক্ত থাকবে। আর কোনোভাবেই বুকের দুধ খাওয়ানো বন্ধ করা যাবে না।

গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে প্রথম আলো কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত ‘২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে হেপাটাইটিস বি নির্মূলে করণীয়’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা এসব কথা বলেন। ২৮ জুলাই বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবস সামনে রেখে হেপাটোলজি সোসাইটি, বাংলাদেশের সহযোগিতায় এ বৈঠকের আয়োজন করে প্রথম আলো

দেশের মোট জনসংখ্যার ৫ দশমিক ১ শতাংশ জনগোষ্ঠী হেপাটাইটিস বি ভাইরাসে আক্রান্ত। সে হিসাবে, দেশের ৫৭ লাখ পুরুষ ও ২৮ লাখ নারী এ রোগে আক্রান্ত। এই প্রেক্ষাপটে হেপাটোলজি সোসাইটি বাংলাদেশের সভাপতি মবিন খান বলেন, ২০১৮ সালের গবেষণা অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে হেপাটাইটিস বি ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব প্রায় ৫০ শতাংশ, যা আগে ছিল ২৭ শতাংশ। রোগনির্ণয়, চিকিৎসার সুবিধা বাড়াতে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে একসঙ্গে কাজ করতে হবে বলে মত দেন তিনি।

হেপাটোলজি সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক মো. শাহিনুল আলম মনে করেন, সরকারি হাসপাতালে হেপাটাইটিস বি-এর টিকা বিনা মূল্যে দেওয়া উচিত। এর চিকিৎসাও হওয়া দরকার সরকারের সহযোগিতায়। ব্লাড ব্যাংকের রক্তের শতভাগ স্ক্রিনিং দরকার বলে মনে করেন তিনি।

বৈঠকে চিকিৎসকেরা জানান, ১৮ থেকে ৪৫ বছর বয়সী প্রজননক্ষম ১৮ লাখ নারী হেপাটাইটিস বি রোগে আক্রান্ত। অথচ মায়ের মাধ্যমেই সবচেয়ে বেশি এ রোগ ছড়ায়। তাঁরা আরও বলেন, ১৫ থেকে ৩০ বছর বয়সী ২৫ লাখ চাকরিপ্রার্থী ও কর্মক্ষম তরুণ হেপাটাইটিস বি রোগে আক্রান্ত। এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার কারণে তাঁরা চাকরি পান না।

বৈঠকটি সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম।

টিকার দাম কমানোর ওপর গুরুত্বারোপ করে বারডেম জেনারেল হাসপাতালের গাইনি স্পেশাল ইউনিট ও কেয়ারের প্রধান পরামর্শক টি এ চৌধুরী বলেন, অনেকে মনে করেন গর্ভবতী অবস্থায় টিকা দেওয়া যাবে না। তাঁর মতে, হেপাটাইটিস বি-এর টিকা মা ও শিশুর শরীরে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে না। 

বিএসএমএমইউর সাবেক উপাচার্য নজরুল ইসলাম বলেন, পাঁচ ধরনের হেপাটাইটিসের মধ্যে এ এবং ই ছড়ায় খাবারের মাধ্যমে। হেপাটাইটিস বি এবং সি প্রাণঘাতী। টিকা, চিকিৎসার পাশাপাশি সচেতনতাও খুব দরকার।

বিএসএমএমইউর লিভার বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. গোলাম মোস্তফা জানান, অনিরাপদ রক্ত সঞ্চালন, ডায়ালাইসিস, অনিরাপদ দৈহিক সম্পর্ক, সিরিঞ্জের মাধ্যমে মাদক নেওয়ায় মূলত ভাইরাসটি ছড়িয়ে থাকে। তবে ছোঁয়াছুঁয়ির মাধ্যমে এ রোগ ছড়ায় না।

স্কয়ার হাসপাতালের পরামর্শক শেখ মোহাম্মদ বাহার হোসেন বলেন, হেপাটাইটিস বি-তে আক্রান্ত ৭০ শতাংশ রোগী জানেন না যে তাঁরা আক্রান্ত।

আইসিডিডিআরবির জ্যেষ্ঠ পরিচালক তাহমীদ আহমেদ বলেন, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার অংশ হিসেবে ২০৩০ সালের মধ্যে আক্রান্তের হার ৭০ শতাংশ কমাতে হবে। আর ৬৫ শতাংশ মৃত্যু কমাতে হবে। এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে প্রয়োজনীয় তথ্য ও উপাত্ত সংগ্রহ, ঝুঁকিপূর্ণ গোষ্ঠী চিহ্নিত করা, খরচ কে বহন করবে, তা নিশ্চিত করা জরুরি।

বারডেম জেনারেল হাসপাতালের শিশু বিভাগের প্রধান আবিদ হোসেন মোল্লা বলেন, প্রায় চার লাখ শিশু হেপাটাইটিস বি-তে আক্রান্ত। যত কম বয়সে শিশুরা হেপাটাইটিসে আক্রান্ত হবে, তত বেশি জটিলতা তৈরি হবে। এ থেকে উত্তরণের একমাত্র উপায় টিকা দেওয়া।

ইব্রাহিম মেডিকেল কলেজের কমিউনিটি মেডিসিন বিভাগের প্রধান মো. আবু সাঈদ বলেন, যেকোনো রোগ চার ধাপে প্রতিরোধ করা হয়। শুরুতেই ঝুঁকিপূর্ণ গোষ্ঠীকে চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সচেতনতামূলক কার্যক্রম শুরু করলে ভালো ফল মিলবে।

বারডেম জেনারেল হাসপাতালের গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজি ও লিভার বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. গোলাম আযম বলেন, এ রোগের ভয়াবহতা উল্লেখ করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২০১০ সালে ২৮ জুলাইকে বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবস ঘোষণা করে।

হেপাটোলজি সোসাইটি বাংলাদেশের সহসভাপতি মো. আবু সাঈদ বলেন, রোগীদের অনেকেই এমন পর্যায়ে চিকিৎসকের কাছে আসেন, যখন আর চিকিৎসার তেমন সুযোগ থাকে না। 

ইপিআই কর্মসূচিতে হেপাটাইটিস বি টিকা যুক্ত হওয়ার কারণে আক্রান্তের হার কমছে বলে মনে করেন বিএসএমএমইউর হেপাটোলজি বিভাগের স্বাস্থ্য কর্মকর্তা মো. সাইফুল ইসলাম। দ্য ভ্যাকসিনেশন অ্যাক্ট-১৮৮০ যুগোপযোগী করা দরকার বলে মন্তব্য করেন প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক মিজানুর রহমান খান।