মানিকগঞ্জে গো-খাদ্য, নিরাপদ আশ্রয়ের অভাবে বিপাকে খামারিরা

উঁচু জায়গায় রাখা হয়েছে গরু। রোববার দৌলতপুরের বাচামারা উচ্চবিদ্যালয় প্রাঙ্গণে।  প্রথম আলো
উঁচু জায়গায় রাখা হয়েছে গরু। রোববার দৌলতপুরের বাচামারা উচ্চবিদ্যালয় প্রাঙ্গণে। প্রথম আলো

মানিকগঞ্জের দৌলতপুর উপজেলার চরাঞ্চলের মানুষের জীবিকার প্রধান অবলম্বন গরু। কোরবানির ঈদে এসব গরু বিক্রি করে যা উপার্জন হয়, তা দিয়েই চলে তাঁদের পরিবারের সারা বছরের খরচ। তবে বন্যায় নিম্নাঞ্চলের বাড়িঘর ও মাঠঘাট তলিয়ে যাওয়ায় এসব গরু নিয়ে বিপাকে পড়েছেন খামারিরা।

নিরাপদ আশ্রয়ের পাশাপাশি দেখা দিয়েছে চরম গো-খাদ্যসংকট। এ পরিস্থিতিতে বানভাসি এসব খামারির কেউ কেউ কম দামে গরু বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন।

সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, উপজেলার বাচামারা, বাঘুটিয়া, চরকাটারি—এই তিন ইউনিয়নের দুর্গম চরাঞ্চলের প্রায় প্রতিটি পরিবার বছরে দুই থেকে পাঁচটি গরু পালন করে থাকে। সাধারণত কোরবানির ঈদ সামনে রেখে এসব গরু পালন করে থাকেন খামারিরা। কোরবানি ঈদে এসব গরু বিক্রি করে যা আয় হয়, তা দিয়ে চলে তাঁদের সংসার। এ ছাড়া তাঁদের বিপদের দিনে অর্থের একমাত্র উৎস এই গবাদিপশু। খামারিরা নিজেদের সন্তান বা পরিবারের সদস্যদের মতোই এসব পশু লালন-পালন করেন। অন্যান্য বছরের মতো এবারও যমুনা নদীর পানি বাড়ায় এসব ইউনিয়নের চরগুলোতে বসতঘরে পানি ওঠে। নিজেদের সঙ্গে অনেকেই এসব গবাদিপশু নিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে গেছেন।

রবি ও সোমবার সরেজমিনে দেখা গেছে, বাচামারা, বাঘুটিয়া ও চরকাটারি ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চলের অনেক গ্রামে বসতভিটায় পানি ওঠায় গবাদিপশু নিয়ে খামারিদের অনেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মাঠসহ উঁচু সড়ক ও বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধে আশ্রয় নিয়েছেন। বাচামারা উচ্চবিদ্যালয় এবং বি বি সি ডিগ্রি কলেজের মাঠে অর্ধশতাধিক খামারি তাঁদের গরু নিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন। এ ছাড়া বাচামারা বাজারের অদূরে বাচামারা-চরকাটারি সড়কের তিন-চারটি স্থানে গরু নিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন বেশ কয়েকজন খামারি। তাঁদের অনেকেই পলিথিন টানিয়ে বৃষ্টি থেকে গরুকে নিরাপদে রাখার চেষ্টা করছেন। বাড়িতে পানি ওঠায় আবার কেউ কেউ উঠানে মাটি ফেলে কিছুটা উঁচু করে গরুগুলো কোনো রকমে রেখেছেন।

বাচামারা উচ্চবিদ্যালয় মাঠে তিনটি ষাঁড় নিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন বাচামারা সকিম মাতবরপাড়া গ্রামের আকতার মণ্ডল। তিনি বলেন, ‘সপ্তাহখানেক আগে বন্যায় আমার বসতভিটা নদীত গ্যাছে। এহন নিজে বাঁচমু, না গরুগুলারে বাঁচামু, বুঝতে পারছি না।’

একই স্থানে আশ্রয় নেওয়া বাচামারা উত্তরখণ্ড গ্রামের আবদুর রহমানের স্ত্রী নূরুন্নাহার বেগম বলেন, ফসলের জমি, মাঠঘাট—সব পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় গো-খাদ্য পাওয়া যাচ্ছে না। ৪০-৪৫ টাকা দরে প্রতি কেজি গমের ভুসি কিনে গরুগুলোতে খাওয়াতে হচ্ছে। তাঁর ধারণা, এতে গরু বিক্রির আয়ের বদলে লোকসান গুনতে হতে পারে।

বাঘুটিয়া ইউনিয়নের পারুরিয়া গ্রামের বকর শেখ বলেন, এবার তিনি চারটি ষাঁড় পালন করেছেন। চারদিকে পানির কারণে কোথাও গো-খাদ্য নেই। এ কারণে খাবারের অভাবে গরুগুলো শুকিয়ে যাচ্ছিল। এ কারণে বাধ্য হয়ে কম দামে দুটি ষাঁড় বিক্রি করেছেন।

বেশ কয়েকজন খামারি জানান, বর্ষার সময় ছাড়া বছরের বাকি সময় চরগুলোতে বিস্তীর্ণ জায়গায় সবুজ ঘাস থাকে। গো-খাদ্য হিসেবে এসব ঘাসের পাশাপাশি গরুগুলোকে ধানের খড় দেওয়া হয়। তবে চলমান বন্যায় গবাদিপশুর খাদ্য নিয়ে দুর্ভোগে পড়েছেন তাঁরা। গবাদিপশুর জন্য আশ্রয়স্থলের ব্যবস্থা করা গেলেও গো-খাদ্যর তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। সরকারিভাবে বন্যার্ত মানুষের জন্য ত্রাণ দেওয়া হলেও গবাদিপশুর জন্য কোনো সহায়তা দেওয়া হচ্ছে না। খাবারের অভাবে গবাদিপশুকে কোনো রকমে গাছের পাতা খাওয়াতে হচ্ছে। অতিরিক্ত অর্থ খরচ করে কেউ কেউ গমের ভুসি খাওয়াচ্ছেন। এর ওপর বন্যার কারণে খুরাসহ বিভিন্ন রোগ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।

দৌলতপুর উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা আবদুর রেজ্জাক প্রথম আলোকে বলেন, উপজেলার চরাঞ্চলের মানুষের প্রধান পেশা হচ্ছে কোরবানির গরু পালন। এ বছর খামারিরা কোরবানির জন্য উপজেলায় প্রায় ৯ হাজার গবাদিপশু পালন করেছেন। রোগ প্রতিরোধের জন্য এসব গবাদিপশুকে ভ্যাকসিন দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া গো-খাদ্যের জন্য খামারিদের নেপিয়ার ঘাসের বীজ ও ঘাস চাষের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে।