জামালপুরে নৌকা দেখে ছুটছে বানভাসি

নৌকা দেখেই ত্রাণের আশায় নদীর পাড়ে চলে এসেছে নারী, পুরুষ, শিশু সবাই। এ দৃশ্য এখন বন্যাকবলিত এলাকাগুলোতে নিয়মিত। ত্রাণের জন্য চলছে হাহাকার। গতকাল দুপুরে জামালপুরের ইসলামপুর উপজেলার শিংভাঙা গ্রামে।  ছবি: প্রথম আলো
নৌকা দেখেই ত্রাণের আশায় নদীর পাড়ে চলে এসেছে নারী, পুরুষ, শিশু সবাই। এ দৃশ্য এখন বন্যাকবলিত এলাকাগুলোতে নিয়মিত। ত্রাণের জন্য চলছে হাহাকার। গতকাল দুপুরে জামালপুরের ইসলামপুর উপজেলার শিংভাঙা গ্রামে। ছবি: প্রথম আলো

শতবর্ষী সত্যবান। ঠিকমতো দাঁড়াতে পারেন না। হাতে লাঠি। তার গভীর প্রতীক্ষা, কেউ হয়তো ত্রাণ নিয়ে আসবেন। কিন্তু কেউ এলেন না।

জামালপুরের ইসলামপুর উপজেলার চিনাডুলী ইউনিয়নের আকন্দপাড়া গ্রামের বাসিন্দা সত্যবানের ঘর বসতঘর বানে পানিতে ভেঙে গেছে। অন্যের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন। সকাল থেকে বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধে ত্রাণের জন্য তাঁর অপেক্ষা।

কাঁপা গলায় সত্যবান বলছিলেন, ‘অনেক দূর থেইকা পানি ভাঙে আইছি। বড় কষ্ট। বানে ঘরঠাও ভাঙা গেছে। ডালাও পানি সব কাইড়া নিল। পুলার বউরে হাতো করে আনছি। সকালে কইড়া মুড়ি খাইছি। কেউ কোনডাই দিব না। বানের আগে ইউনিয়ন বোর্ড থেকে পাঁচ সের চাল পাইছুলাম। বানের আগে ফুড়ায় গেছে। বান যাইতাছে, চিড়া-মুড়ি খাইয়া রইছি। আমগরে মেলা কষ্ট। পুলাপানও দেখে না।’

ইসলামপুরে বানের পানি টান দিয়েছে। তারপরও উপজেলার শিংভাঙা, বাবনা, পূর্ব বাবনা, পশ্চিম বাবনা, মাঝিপাড়া, দেলিরপাড়সহ বহু গ্রামে এখনো বুকসমান পানি। লন্ডভন্ড ঘরবাড়ি ছেড়ে এখনো গুঠাইল বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধ, উঁচু রাস্তা ও সেতুতে আছে অনেকে। হাজার হাজার বানভাসি এসব জায়গায় ছাপরা ঘরে রোদ আর বৃষ্টিতে দিন কাটাচ্ছে।

গত ১২ দিন পানির সঙ্গে যুদ্ধ করে বানভাসি মানুষের মধ্যে ত্রাণের জন্য চলছে হাহাকার। শত শত বানভাসি যাত্রীবাহী নৌকা দেখলেই ত্রাণ পাওয়ার আশায় ছোটাছুটি ও হুড়োহুড়ি শুরু করে দেয়। আবার অনেকেই ভোর থেকে ত্রাণের জন্য উঁচু স্থান বা চেয়ারম্যান বাড়িতে ধরনা দিচ্ছে। অনেকে ত্রাণ না পেয়ে খালি হাতে ফিরে যাচ্ছে।

গতকাল শনিবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত বন্যাকবলিত বিভিন্ন এলাকা ঘুরে এই চিত্র দেখা গেছে।

শিংভাঙা গ্রামে এখনো বুকসমান পানি। নৌকা দেখেই বানভাসি মানুষ ছোটাছুটি শুরু করে দিল। তারা একটি উঁচু স্থানে গিয়ে হাত ইশারা করছে। বানভাসি সুহাগী বেগম, ফুলেরা বেগম, আমেনা বেগম, নছিরণ বেগম, আবদুল মালেকসহ আরও অনেকের সঙ্গে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। তাঁরা বলেন, টানা ১২ দিন ধরে তাঁরা পানিবন্দী। কোনো খাবার নেই। পানি কমতে শুরু করলেও এই এলাকায় এখনো বুকসমান পানি। শুধু ঘরবাড়ি জেগেছে। তবে তীব্র পানির তোড়ে সেসব ঘরবাড়ি লন্ডভন্ড হয়ে গেছে। কোনো রকমে তাঁরা বেঁচে আছেন। চারদিকে পানি। নৌকা ছাড়া কোথাও যাওয়া যায় না। অনেকের পানিবাহিত রোগ দেখা দিয়েছে।

বানভাসিদের এসব কথা শুনতে শুনতেই নাছিমা বেগম নামের এক গৃহবধূ কান্না ভেঙে পড়েন। তিনি বলেন, তাঁর স্বামী দিনমজুর। বানের পানি তাঁদের সবকিছু নিয়ে গেছে। তিন বছর বয়সী এক মেয়ে রয়েছে। সেই মেয়েটিকে পর্যন্ত ঠিকমতো খাবার দিতে পারছেন না। দুই দিন ধরে তাঁদের মেয়ে অসুস্থ। ডায়রিয়া হয়েছে। হাতে কোনো টাকা নেই। ১ হাজার টাকা ঋণ করে গুঠাইল গিয়ে ওষুধ এনেছেন। তিনি বলেন, ‘আমরা যে কতটা কষ্টে আছি। কাউকে বোঝাতে পারব না।’

চিনাডুলী ইউপি চেয়ারম্যান আবদুস সালাম জানান, তিনি সরকারি যেসব ত্রাণসামগ্রী বরাদ্দ পেয়েছিলেন, অনেক আগেই তা বানভাসিদের দেওয়া হয়েছে। তিনি বরাদ্দ না পেলে বানভাসিদের দেবেন কীভাবে। বানভাসি মানুষ এখন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত তাঁর বাড়িতে এসে বসে থাকে। তাদের দেখে তাঁরও খুব কষ্ট হয়। তাই নানা জায়গায় যোগাযোগ করে ত্রাণসামগ্রী তাঁর এলাকায় বিতরণের অনুরোধ করছেন।

ত্রাণসামগ্রীর অপ্রতুলতার বিষয়টি অস্বীকার করে জেলা প্রশাসক আহমেদ কবীর জানান, সারা জেলায় বানভাসিদের মধ্যে ২ হাজার ২৫০ মেট্রিক টন চাল, ১৫ লাখ টাকা ও ৩ হাজার শুকনো খাবার বিতরণ করা হয়েছে। অনেক এলাকায় ত্রাণসামগ্রী যায়নি, কথাটি সত্য নয়। তাঁর দাবি, জেলা প্রশাসনের একাধিক দল দুর্গত এলাকার প্রতিটি গ্রামে ত্রাণ পৌঁছে দিচ্ছে। ত্রাণসামগ্রী বিতরণ এখনো চলছে। তাঁদের হাতে আরও ত্রাণসামগ্রী আছে। সেগুলো বিতরণ করা হচ্ছে।

শেরপুর-জামালপুর আঞ্চলিক সড়কে পুনরায় যানবাহন চলাচল শুরু হয়েছে।  প্রথম আলো
শেরপুর-জামালপুর আঞ্চলিক সড়কে পুনরায় যানবাহন চলাচল শুরু হয়েছে। প্রথম আলো

শেরপুর-জামালপুর সড়ক যোগাযোগ চালু

আমাদের শেরপুরের প্রতিনিধি জানান, ব্রহ্মপুত্র নদের পানি হ্রাস পাওয়ায় শেরপুরের সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। ৯ দিন বন্ধ থাকার পর গতকাল সকাল থেকে শেরপুর-জামালপুরের মধ্যে সড়ক যোগাযোগ পুনরায় চালু হয়েছে।

পানি উন্নয়ন বোর্ড, শেরপুরের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী মো. মাজহারুল ইসলাম জানান, ব্রহ্মপুত্র সেতু পয়েন্টে গতকাল বিপৎসীমার ৪৫ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে পানি প্রবাহিত হয়েছে। ফলে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে।

বন্যায় শেরপুর-জামালপুর সড়কের পোড়ার দোকান ও শিমুলতলী এলাকায় দুটি কজওয়ের ওপর দিয়ে প্রবল বেগে পানি প্রবাহিত হয়। ফলে ১৮ জুলাই থেকে ওই সড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। পানি কমে যাওয়ায় গতকাল থেকে যানবাহন চলাচল শুরু হয়েছে।