ঢাকার সড়কে মৃত্যু কমেনি

এত প্রচারণা ও কর্মসূচির পরও সড়কে ফিরছে না শৃঙ্খলা। সড়কের মাঝখানে যত্রতত্র বাস থামিয়ে চলছে যাত্রী ওঠা–নামা। ঝুঁকি বাড়ছে দুর্ঘটনার। সৃষ্টি হচ্ছে যানজট। গতকাল বিকেলে রাজধানীর  নদ্দা বাসস্ট্যান্ড এলাকায়।  ছবি: সাইফুল ইসলাম
এত প্রচারণা ও কর্মসূচির পরও সড়কে ফিরছে না শৃঙ্খলা। সড়কের মাঝখানে যত্রতত্র বাস থামিয়ে চলছে যাত্রী ওঠা–নামা। ঝুঁকি বাড়ছে দুর্ঘটনার। সৃষ্টি হচ্ছে যানজট। গতকাল বিকেলে রাজধানীর নদ্দা বাসস্ট্যান্ড এলাকায়। ছবি: সাইফুল ইসলাম

ঢাকায় সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু কমেনি। গত এক বছরে ঢাকায় সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ২৯৭ জন। নিহত ব্যক্তিদের প্রায় ৩৮ শতাংশই পথচারী।

সড়কে মৃত্যুর এই হিসাব বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই)। ২০১৮ সালের ১ জুলাই থেকে চলতি বছরের ১ জুলাই পর্যন্ত ঢাকায় সড়ক দুর্ঘটনার তথ্য পর্যালোচনা করে প্রতিষ্ঠানটি সর্বশেষ এই হিসাব দিয়েছে। আর এসব মৃত্যুর ঘটনায় হওয়া মামলার তথ্য-উপাত্ত পর্যালোচনায় দেখা গেছে, এই সময়ে ঢাকা শহরে শুধু বিমানবন্দর সড়কে মারা গেছেন ৪৬ জন। এআরআইয়ের হিসাব অনুযায়ী, ২০১৭ সালে ঢাকায় সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন ২৭৬ জন।

এক বছর আগে ২৯ জুলাই এই বিমানবন্দর সড়কে বাসের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকা শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের শিক্ষার্থীদের ওপর বাস তুলে দিয়েছিলেন বেপরোয়া চালক। নিহত হয় কলেজের দুই শিক্ষার্থী দিয়া খানম মিম ও আবদুল করিম রাজীব। এ ঘটনার পর নিরাপদ সড়কের দাবিতে রাস্তায় নামেন স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা। তখন সড়কে নৈরাজ্য বন্ধে ঢাকা মহানগর পুলিশ ও সরকারের অন্যান্য সংস্থা নানা উদ্যোগের কথা বলেছিল। কিন্তু আন্দোলনের এক বছর পার হলেও সেগুলোর পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়নি। ঢাকার সড়কে ফেরেনি শৃঙ্খলা।

সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে তখন রাস্তায় নামা শিক্ষার্থীরা সরকারদলীয় ছাত্রসংগঠনের হেলমেট পরা নেতা-কর্মীদের হামলার শিকার হয়েছিল। এতে আহত হন সাংবাদিকেরাও। সেই ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। অথচ আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে করা মামলা এখনো চলছে। সপ্তাহব্যাপী চলা ওই আন্দোলনের ঘটনায় শিক্ষার্থীসহ কয়েক শ ব্যক্তির নামে ঢাকা মহানগরের বিভিন্ন থানায় ৬০টি মামলা হয়। এসব মামলায় তখন ৯৯ জন কারাভোগ করেন। এঁদের মধ্যে ৫২ জন শিক্ষার্থী। এসব শিক্ষার্থী জামিনে থাকলেও এখনো আদালতে হাজিরা দিয়ে যেতে হচ্ছে।

ঢাকার আদালত, আইনজীবী ও পুলিশ সূত্রগুলো বলছে, ৬০টি মামলার মধ্যে দুটিতে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দিয়েছে পুলিশ। দুটি মামলায় দেওয়া হয়েছে চূড়ান্ত প্রতিবেদন (অব্যাহতির সুপারিশ)। বাকি মামলাগুলোর তদন্ত চলছে।

একটি মামলার আসামি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র জাহিদুল হকের মা জাহানারা হক গতকাল রোববার প্রথম আলোকে বলেন, মিথ্যা হয়রানিমূলক মামলায় তাঁর ছেলেকে পুলিশ ধরে নিয়ে যায়। জেলও খেটেছে। এখন প্রতি মাসে আদালতে হাজিরা দিতে হচ্ছে। মামলা থাকায় তাঁর ছেলে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। ব্যাহত হচ্ছে লেখাপড়া। কবে যে তাঁর ছেলে মামলা থেকে রেহাই পাবে, তা জানেন না।

এক বছরেও আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে করা মামলার তদন্ত শেষ না হওয়ার ঘটনা খুবই দুঃখজনক বলে মন্তব্য করেছেন সাবেক আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সাক্ষ্য-প্রমাণ না পেলে যত দ্রুত সম্ভব শিক্ষার্থীদের মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়া উচিত।

কেন মৃত্যু কমেনি
শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যুর ঘটনায় উচ্চ আদালতের নির্দেশে তদন্ত কমিটি হয়। বুয়েটের এআরআইয়ের পরিচালক মিজানুর রহমানের নেতৃত্বে তদন্ত কমিটি উচ্চ আদালতে প্রতিবেদন জমা দেয়। ওই প্রতিবেদন বলছে, ঢাকার সড়ক দুর্ঘটনার জন্য বিদ্যমান গণপরিবহন ব্যবস্থার বিশৃঙ্খলা দায়ী। গণপরিবহন কমলেও ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। বাসের একাধিক রুট বিদ্যমান, যা বিজ্ঞানসম্মত নয়। নিয়োগপত্র ছাড়াই দৈনিক চুক্তির ভিত্তিতে চালক নিয়োগ দেওয়া হয়। দিন শেষে চালকের কাছ থেকে টাকা আদায় করে থাকেন বাসমালিক। তেলসহ নানা আনুষঙ্গিক খরচ মেটাতে গিয়ে মারাত্মক চাপে পড়েন চালকেরা।

>

নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের ১ বছর
সড়কে নৈরাজ্য বন্ধে নানা উদ্যোগের কথা বলা হয়েছিল
উদ্যোগগুলোর পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়নি
ঢাকার সড়কে ফেরেনি শৃঙ্খলা
মামলার কারণে শিক্ষার্থীদের লেখাপড়া ব্যাহত
হেলমেট বাহিনীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি

বুয়েটের সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক কাজী মো. সাইফুন নেওয়াজ প্রথম আলোকে বলেন, নিরাপদ সড়কের দাবিতে বড় আন্দোলন হলো। কিন্তু ঢাকায় সড়ক দুর্ঘটনা কমল না, বরং আগের মতোই গণপরিবহনে বিশৃঙ্খলা রয়ে গেছে। বাস্তবে সড়ক দুর্ঘটনা রোধে দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি নেই।

বিমানবন্দর সড়কে মৃত্যু
ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতের সাধারণ নিবন্ধন খাতার তথ্য পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ঢাকা মহানগরের মধ্যে বিমানবন্দর সড়কে সড়ক দুর্ঘটনায় তুলনামূলক বেশি লোক মারা যাচ্ছেন। প্রাণঘাতী এই সড়কে বিগত চার বছরের বেশি সময়ে মারা গেছে ২০৪ জন।

গত ১১ ফেব্রুয়ারি বিমানবন্দর সড়কের জোয়ারসাহারা বাসস্ট্যান্ডের সামনে বাসের ধাক্কায় ১৮ বছর বয়সী অজ্ঞাত এক যুবক ঘটনাস্থলে নিহত হন। এ ঘটনায় পুলিশ কর্মকর্তা মোফাখখারুল খিলক্ষেত থানায় মামলা করেন।

খিলক্ষেত থানার পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) আবুল বাসার মুহাম্মদ আসাদুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, বাসচালক, মোটরসাইকেলচালক বেপরোয়া গতি নিয়ে গাড়ি চালাচ্ছে। বেশির ভাগ পথচারীরা পদচারী-সেতু ব্যবহার করেন না। ফলে এই সড়কে মৃত্যু থামছে না।

সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মামলার নথিপত্র পর্যালোচনায় দেখা গেছে, হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সামনের গোলচত্বরসহ বিমানবন্দর সড়কের ২৩টি স্থানে সড়ক দুর্ঘটনা বেশি হচ্ছে।

ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ট্রাফিক) মফিজ উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, নানাবিধ কারণে ঢাকায় সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু কমছে না। তবে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু কমিয়ে আনার জন্য পুলিশের পক্ষ থেকে সব ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।

তবে সড়ক দুর্ঘটনা রোধে সড়ক পরিবহন আইনের প্রয়োগ হচ্ছে না বলে মনে করেন নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) আন্দোলনের চেয়ারম্যান ও চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ঢাকার রাস্তায় ফিটনেসবিহীন গাড়িও চলছে। চালকেরা বেপরোয়াভাবে গাড়িও চালাচ্ছেন। গাড়ি চালিয়ে মানুষও মারছেন। সড়কে মৃত্যু কমাতে হলে গণপরিবহন শৃঙ্খলায় আনতে হবে। বিদ্যমান আইনের কঠোর প্রয়োগ করতে হবে।