প্রতারণায় ভোগান্তি হজযাত্রীদের

প্রতারণার শিকার হয়ে নির্ধারিত সময়ে হজে যেতে পারেননি ফখরুজ্জামান। এ কথা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। গতকাল আশকোনায় হজ ক্যাম্পে।  ছবি: প্রথম আলো
প্রতারণার শিকার হয়ে নির্ধারিত সময়ে হজে যেতে পারেননি ফখরুজ্জামান। এ কথা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। গতকাল আশকোনায় হজ ক্যাম্পে। ছবি: প্রথম আলো

খাদিজা খানম ২০১৭ সাল থেকে প্রস্তুতি নিয়েছেন পবিত্র হজ পালনের জন্য। এ বছর ৩ লাখ ২০ হাজার টাকা দিয়েছেন। সব প্রস্তুতি সম্পন্ন। ২৬ জুলাই ফ্লাইট। কিন্তু নির্ধারিত সময়ে বিমানবন্দরে গিয়ে জানতে পারলেন, তাঁর ভিসাই হয়নি। তিনি ও তাঁর স্বামী শেখ মহসিন হোসেন এখনো ভিসার আশায় দিন গুনছেন। এখন তাঁদের বলা হচ্ছে, আরও ৫০ হাজার টাকা করে দিতে হবে।

হজ এজেন্সি ও ‘দালালের’ প্রতারণার কারণে বাগেরহাট থেকে আসা এই দম্পতিকে চরম ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে। খাদিজা খানম ও তাঁর স্বামী মহসিনসহ অন্তত ৫৮ জন গতকাল পর্যন্ত ঢাকা ছাড়তে পারেননি। তাঁদের যাওয়ার কথা ছিল ২৬ জুলাই। তাঁরা সবাই খুলনা ও বাগেরহাট অঞ্চলের। এর বাইরে অন্য দুটি এজেন্সির আরও ২০ জনের ভিসাসংক্রান্ত জটিলতা রয়েছে।

তবে সংশ্লিষ্ট হজ এজেন্সির দাবি, ‘গ্রুপ লিডার’ শামসুজ্জামান ওরফে তোহা হজযাত্রীদের টাকা আত্মসাৎ করায় এই সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। ভুক্তভোগী হজযাত্রীরা হজে যাওয়ার জন্য তাঁকে টাকা দিয়েছিলেন।

ধর্ম মন্ত্রণালয়, হজ এজেন্সিস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (হাব) ও হজযাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, অন্য বছরের তুলনায় এবার হজযাত্রীদের প্রতারণা তুলনামূলক কম। বিদেশ ভ্রমণ ও স্বদেশ ওভারসিজ নামের দুটি হজ এজেন্সির ১৭৩ জন হজযাত্রীকে নিয়ে জটিলতা তৈরি হয়। গত শুক্রবার তাঁদের ফ্লাইট ছিল। ওই দুটি এজেন্সি সৌদি আরবে বাড়ি ভাড়া না করায় এবং ভিসা না হওয়ায় এই জটিলতা তৈরি হয়েছিল। পরে ধর্ম মন্ত্রণালয় ও হাব সভাপতির মধ্যস্থতায় শুক্রবার রাতে ও পরে তাঁদের বেশির ভাগকে সৌদি আরব পাঠানো সম্ভব হলেও গতকাল পর্যন্ত অন্তত ৫৮ জনের যাওয়া নিশ্চিত হয়নি। তাঁরা তিন দিন ধরে ঢাকায় হজ ক্যাম্প ও এর আশপাশে অবস্থান করছেন।

হাবের সভাপতি শাহাদাত হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা হাব থেকে ব্যবস্থা নিয়েছেন। ইতিমধ্যে ১০০ জনের বেশি হজযাত্রী পাঠানো হয়েছে। তাঁরা আশা করছেন, সমস্যার সমাধান হবে।

খাদিজা, মহসিন, আইয়ুব হোসেন, বদিউজ্জামানসহ আরও কয়েকজনের সঙ্গে গতকাল রোববার হজ ক্যাম্পে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তাঁদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বাগেরহাটের ফকিরহাটের স্থানীয় একটি মাদ্রাসার ভাইস প্রিন্সিপ্যাল শামসুজ্জামান তোহার সৌদি–বাংলা ট্যুরিস্ট নামে একটি প্রতিষ্ঠান আছে। তাঁরা জানতেন, ওই প্রতিষ্ঠানটি নিবন্ধিত হজ এজেন্সি। আসলে এটি নিবন্ধিত নয়। হজে যাওয়ার জন্য তাঁরা তোহাকে ৩ লাখ ২০ হাজার থেকে ৩ লাখ ৮০ টাকা করে দেন। গত শুক্রবার দুপুর পর্যন্ত তোহার সঙ্গে তাঁদের যোগাযোগ ছিল। কিন্তু বিমানবন্দরে ঢুকে বোর্ডিংয়ে গিয়ে তাঁরা জানতে পারেন, তাঁদের ভিসাই হয়নি। এরপর থেকে তাঁরা আর তোহাকে ফোনেও পাচ্ছেন না।

হজযাত্রী আইয়ুব হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘২৬ জুলাই ফ্লাইট ছিল। আমার লাগেজও চলে যায়। পরে জানতে পারলাম ভিসাই হয়নি। এরপর কর্মকর্তাদের সহায়তায় অনেক কষ্টে লাগেজ ফেরত এনেছি।’

আরেকজন হজযাত্রী ফখরুজ্জামান কথা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন। তিনি বলছিলেন, ‘কীভাবে যাব, একটা কায়দা করে দেন।’

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বাস্তবে সৌদি–বাংলা নিবন্ধিত কোনো হজ এজেন্সি নয়। শামসুজ্জামান মূলত স্বদেশ ওভারসিজ ও বিদেশ ভ্রমণ নামের ওই দুটি নিবন্ধিত এজেন্সির হয়ে কাজ করতেন। তাদের হজযাত্রী সংগ্রহ করে দিতেন।

ভুক্তভোগীরা জানান, গতকাল তাঁদের কাছে খবর পাঠানো হয়েছে আরও ৫০ হাজার করে টাকা দিতে হবে। কারণ, সৌদি আরবে বাড়ি ভাড়া হয়নি। ২৬ তারিখের টিকিট বাতিল হওয়ায় কিছু টাকাও কেটে রাখবে।

স্বদেশ ওভারসিজের স্বত্বাধিকারী খায়রুল ইসলাম দাবি করেন, তোহা হজযাত্রীদের টাকা আত্মসাৎ করেছেন। এ কারণে ওই সমস্যা তৈরি হয়েছে। তবে তাঁরা এখন বিকল্প ব্যবস্থা করছেন। এখন পর্যন্ত ৪৫ জন যাওয়ার বাকি আছে।

আর বিদেশ ভ্রমণ এজেন্সির স্বত্বাধিকারী মো. ওমর ফারুক প্রথম আলোকে বলেন, ১২৩ জনের মধ্যে ১৩ জন ছাড়া বাকি সবাই ইতিমধ্যে চলে গেছেন। বাকিরাও যেতে পারবেন।

ধর্ম মন্ত্রণালয়ের সচিব আনিছুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, দুটি হজ এজেন্সি নিয়ে ঝামেলা চলছে। মন্ত্রণালয় ছাড় দিচ্ছে না। প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। ইতিমধ্যে অনেকে চলে গেছেন। বাকিরাও যাবেন। সব হজযাত্রীকে পাঠানোর পর ওই দুটি এজেন্সির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিনি বলেন, হজযাত্রীদের মন্ত্রণালয় বলে দিয়েছে, যেন অতিরিক্ত কোনো টাকা কেউ না দেন। সংশ্লিষ্ট এজেন্সিকেই ব্যবস্থা করতে হবে। তিনি বলেন, অজ্ঞাতসারে কেউ টাকা দিয়ে থাকলে সে ক্ষেত্রে কিছু করার থাকে না।