কাঁঠালের হাট

মৌলভীবাজার-কুলাউড়া সড়কের কুলাউড়া উপজেলার ব্রাহ্মণবাজার এলাকায় রাস্তার পাশে স্তূপ করে রাখা কাঁঠাল। গত সোমবার তোলা ছবি l প্রথম আলো
মৌলভীবাজার-কুলাউড়া সড়কের কুলাউড়া উপজেলার ব্রাহ্মণবাজার এলাকায় রাস্তার পাশে স্তূপ করে রাখা কাঁঠাল। গত সোমবার তোলা ছবি l প্রথম আলো

ভোর থেকে হালকা বৃষ্টি হচ্ছিল। সকাল বেলায় বৃষ্টি কমে এলেও মেঘলা আকাশ ও ঠান্ডা হাওয়ায় তখনো বৃষ্টির আমেজ। এরই মধ্যে এক-দুজন কাঁঠাল নিয়ে আসতে শুরু করেন। দেখতে দেখতে সকাল আটটা-নয়টার মধ্যে খালি জায়গা কাঁঠাল ও ক্রেতা-বিক্রেতার উপস্থিতিতে অনেকটাই ভরে ওঠে। বাতাসে তখন পাকা কাঁঠালের ঘ্রাণ। হাট পেয়েছে কাঁঠালের রং।
গত সোমবার মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার ব্রাহ্মণবাজারের সকালটা এ রকমই ছিল। এদিন সাপ্তাহিক হাটবার। এ ছাড়া বৃহস্পতিবারেও হাট বসে। তবে কাঁঠালের মৌসুমে এই সাপ্তাহিক দুই হাটবার পায় নতুন চেহারা। জেলার অন্যতম কাঁঠালের হাট এটি।
সাইকেলে কাঁঠাল ঝুলিয়ে হাটে ঢুকছিলেন নন্দলাল (৪০)। প্রায় সাড়ে তিন কিলোমিটার দূরের লংলা থেকে এসেছেন। তাঁর সাইকেলে ঝোলানো ১২টি কাঁঠাল। বললেন, ‘এই কাঁঠাল ১২০০ টাকা দাম চাইব। এখন কত পাব জানি না। প্রত্যেক হাটবারে আসি। এগুলো আমার গাছের কাঁঠাল।’ তাঁর সঙ্গে আসা জসিম মিয়া (২৪) জানালেন, তাঁর সাইকেলে ১৬টি কাঁঠাল। তিনি ১ হাজার টাকা দাম চাইবেন। সাইকেলে কাঁঠাল নিয়ে আসা লোকের সংখ্যা অর্ধশতাধিকের কম নয়। ততক্ষণে বেলা আরও বেড়েছে। মৌলভীবাজার-কুলাউড়া সড়কের ব্রাহ্মণবাজারের পূর্ব দিকে রাস্তার দুই পাশে তখন তৈরি হয়েছে সারি সারি কাঁঠালের স্তূপ। কাঁধ ভাঁড়, ঠেলাগাড়ি, রিকশা, সিএনজিচালিত অটোরিকশা, মিনি ট্রাক ইত্যাদি বাহনে কাঁঠাল নিয়ে এসেছেন কাঁঠালচাষি ও ব্যবসায়ীরা। এ রকম হাটবারে ৩০০ থেকে ৪০০ জন কাঁঠাল নিয়ে আসেন। তাঁরা আসেন কুলাউড়া উপজেলার বুধপাশা, রাঙ্গিছড়া, কালিটি, মুমিনছড়া, রাজনগর, লংলা, আলীনগর, কাজলধারা, হিংগাজিয়া, হাজীপুর, কাচারি ইত্যাদি গ্রাম থেকে।
হিংগাজিয়া থেকে কাঁঠাল নিয়ে আসা মুসলিম মিয়া বলেন, ‘১৫ বছর বয়স থাকি কাঁঠাল লইয়া বাজারো আই। আমরার এলাকাত কাঁঠালর। ইলা বাজার আর নাই। আর এই বাজারে ৭০ থাকি ৮০টা গ্রামের মানুষ কাঁঠাল লইয়া আয়। এবার কাঁঠালর উৎপাদন ভালা অইছে। কিন্তু রোজার কারণে বাজার কিছু মন্দা।’ তিনি জানালেন, হাটে ১০০ কাঁঠাল ২ থেকে ৮ হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে।
টাটুরা গ্রামের আলী হোসেন (২১) বলেন, বৈশাখ থেকে কাঁঠালের হাট বসে। চলে আষাঢ় পর্যন্ত। তবে জ্যৈষ্ঠ মাসেই জমে বেশি। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রাস্তার প্রায় আধ কিলোমিটারের দুই পাশে স্তূপের পর স্তূপ কাঁঠাল জমতে থাকে। কেউ ট্রাক থেকে কাঁঠাল নামিয়ে স্তূপ করছেন। কেউ স্তূপ থেকে কাঁঠাল ট্রাকে তুলছেন। যেদিকেই তাকানো যায় শুধুই ছোট-বড় কাঁঠালের স্তূপ। কাঁঠালের রঙে সেজে ওঠে হাটটি।
আবদুল মান্নান (৭০) বলেন, ‘আমি কাঁঠাল কিনে বিক্রি করি। চাইর-পাঁচ শ টাকা পাইলে পাইলাম।’ তিনি বলেন, কাঁঠালের এই হাটের বয়স ৭০ থেকে ৮০ বছরের কম হবে না। এখানে আগে ভাটি অঞ্চল থেকে নৌকা নিয়ে আসতেন পাইকারেরা। নৌকা বোঝাই করে ফিরতেন তাঁরা। এখন রাস্তা পাকা হয়েছে। গাড়িতে করে নিয়ে যান। এখনো সিলেট, ফেঞ্চুগঞ্জ, বালাগঞ্জ, বিশ্বনাথ, মৌলভীবাজার, গোয়ালাবাজার, জগন্নাথপুর, বিয়ানীবাজারসহ বিভিন্ন স্থান থেকে পাইকারেরা আসেন। সকাল থেকে এই হাট জমতে শুরু করে। বিকেল তিনটা-চারটার দিকে শেষ হয়। হাটের সময়টাজুড়ে ক্রেতা-বিক্রেতার হাঁকাহাঁকিতে তখন কাঁঠালের হাটটি উৎসবের মতো হয়ে ওঠে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর মৌলভীবাজার কার্যালয়ের উপপরিচালক মো. শাহজাহান গতকাল বলেন, এ বছর ২ হাজার ২০০ হেক্টর জমিতে কাঁঠালের চাষ হয়েছে। কাঁঠালের উৎপাদনও ভালো হয়েছে।