রোহিঙ্গা শিবিরের কিশোর-কিশোরীদের নিয়ে উদ্বেগ প্রশাসনে

ছবি: রয়টার্স
ছবি: রয়টার্স

ময়নারঘোনা শফিকুল্লাহকাটার গ্লোবাল রিলিফ হাসপাতালের সামনে খোলা মাঠ। শরণার্থী শিবিরের শিশুদের খেলার বন্দোবস্ত আছে সেখানে। কাছেই এক আড্ডায় পাওয়া গেল সাত-আটজন কিশোরকে। তারা জানাল, দিনভর আড্ডা দেওয়া ছাড়া কোনো কাজ নেই তাদের। বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মনে করছে, দ্রুত প্রত্যাবাসন না হলে এরাই একদিন মাথাব্যথার কারণ হয়ে যাবে।

টেকনাফ-উখিয়ার শরণার্থী শিবিরগুলোয় কর্মরত আন্তর্জাতিক মানবিক সহায়তা দানকারী সংগঠনগুলোর জোট ইন্টার সেক্টরাল কো-অর্ডিনেশন গ্রুপের (আইএসসিজি) হিসাবে টেকনাফ উখিয়ার ৩৮টি শরণার্থী শিবির ও ১টি আশ্রয়কেন্দ্রে ১২ থেকে ১৭ বছর বয়সীদের সংখ্যা ১ লাখ ২০ হাজার ৯২৬। এদের মধ্যে ৬০ হাজার ১১৯ জন কিশোরী ও ৬০ হাজার ৮০৭ জন কিশোর।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উদ্বেগের কারণ রোহিঙ্গা শিবিরে বিভিন্ন সংঘবদ্ধ সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর উপস্থিতি। এসব গোষ্ঠী ইয়াবা ও মানব পাচার, খুন, অপহরণ, ডাকাতি, ধর্ষণের মতো অপরাধে যুক্ত। ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত মাদক, মানব পাচার, হত্যা, ধর্ষণ, অপহরণ, ডাকাতি ও ডাকাতির প্রস্তুতি, অস্ত্র আইন ও ফরেনার্স অ্যাক্টে কক্সবাজার জেলায় ৪২৯টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় আসামির সংখ্যা ৯৯০। এ সময়ে শরণার্থী শিবিরে হত্যা মামলা হয়েছে ৩৯টি। এর বাইরে মাদক মামলা ১৮২টি, ধর্ষণ ও ধর্ষণচেষ্টার ৩০টি, অপহরণ ১৩টি ও ডাকাতির ৯টি মামলা হয়েছে।

বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের টেকনাফ ২ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক মো. ফয়সাল হাসান খান, কক্সবাজারের ভারপ্রাপ্ত পুলিশ সুপার মো. ইকবাল হোসেন, র‍্যাব–১৫–এর অধিনায়ক মো. আজিম আহমেদ বলেছেন, এখন ইয়াবা কারবারিরা রোহিঙ্গাদের দিয়ে ইয়াবা আনা–নেওয়ার কাজ করছেন। এর বাইরে বিভিন্ন জঙ্গিগোষ্ঠীরও নজর রয়েছে এই শিবিরগুলোয়।

গত শুক্রবার ময়নারঘোনা শফিকুল্লাহকাটা ও বিশ্বের বৃহত্তম শরণার্থী শিবির কুতুপালং-বালুখালিতে ঘুরে জানা গেছে, শরণার্থী কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে যারা সামান্য লেখাপড়া জানে, তারা শিবিরের ভেতরে ছোটখাটো কাজ করে। একটি অংশের মাদ্রাসায় যাওয়া–আসা আছে। যদিও মাদ্রাসায় কত কিশোর-কিশোরী যাচ্ছে, তার কোনো হিসাব নেই। সবচেয়ে বড় অংশটি লেখাপড়াতেও নেই, হাতে-কলমেও কিছু শিখছে না।

>

টেকনাফ উখিয়ার ৩৮টি শরণার্থী শিবির ও ১টি আশ্রয়কেন্দ্রে ১২ থেকে ১৭ বছর বয়সীদের সংখ্যা ১ লাখ ২০ হাজার ৯২৬। এদের মধ্যে ৬০ হাজার ১১৯ জন কিশোরী ও ৬০ হাজার ৮০৭ জন কিশোর।

রোহিঙ্গা রিফিউজি রিপ্যাট্রিয়েশন কমিশনের অতিরিক্ত কমিশনার শামসুদ্দোজা প্রথম আলোকে বলেন, ১২-১৭ বছর বয়সীরা তাঁদেরও ভাবাচ্ছে।

ময়নারঘোনা শফিকুল্লাহকাটায় দুস্থ স্বাস্থ্যকেন্দ্রের বারান্দায় প্রথম আলোর সঙ্গে কথা হয় মো. একরাম, মো. রহিমুল্লাহ, মো. সলিম, মো. শাকের, মো হারুন, মো. জুবায়ের ও মো. সাদিকের। কে কী করেছে জানতে চাইলে, জবাব আসে অভিন্ন। ভোরে ঘুম থেকে উঠে নামাজ পড়েছে, হাত-মুখ ধুয়ে কিছু একটা মুখে দিয়ে আড্ডায় বসেছে। এদের মুঠোফোন আছে। মুঠোফোনে ভিডিও দেখে, ক্যারম বা লুডু খেলে। সূর্য ডুবলে শিবিরের ভেতরে নিজেদের খুপরি ঘরে চলে যায়।

মো জুবায়ের বুচিদংয়ের খানসামার বাসিন্দা ছিল। ওখানে ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছে। শরণার্থী শিবিরে একাধিক বেসরকারি সংস্থায় কাজ করেছে দুই হাজার টাকা পর্যন্ত বেতনে। এখন কাজ নেই। জুবায়ের প্রথম আলোকে বলে, শরণার্থী শিবিরে খাবারের কষ্ট নেই। কিন্তু যদি বাংলাদেশে দীর্ঘ সময় থেকে যেতে হয়, তাহলে তারা কী করবে, তা নিয়ে চিন্তা হয়।

শরণার্থী শিবিরে কিশোরীদের সমস্যার ধরন আলাদা। তাদের বড় অংশও লেখাপড়া বা কোনো কাজের সঙ্গে যুক্ত নয়। সারা দিন বসে থেকে দিন কাটায়। অভিভাবকেরা মনে করেন শরণার্থী শিবিরের পরিবেশ কিশোরীদের উপযুক্ত নয়। নূর ফাতেমা নামের এক নারী বলছিলেন, তাঁদের ঘর থেকে শৌচাগার বেশ দূরে। তাঁর ছোট বোন জয়নাব বাড়ির পুরুষ সদস্যদের ছাড়া বের হতে পারে না। কারণ, শিবিরের পরিবেশ নিরাপদ নয়।

আইএসসিজির মুখপাত্র সৈকত বিশ্বাস প্রথম আলোকে বলেন, কিশোর-কিশোরীদের কাজ শেখানোর অনুমতি চেয়ে তাঁরা বাংলাদেশকে অনুরোধ জানিয়েছেন। কীভাবে কিশোর-কিশোরীদের উৎপাদনশীল কাজে যুক্ত করা যায়, তা নিয়ে আলোচনাও চলছে।

তবে, মোটা দাগে কিশোর-কিশোরীদের লেখাপড়া বা কোনো কাজে সম্পৃক্ত না হওয়ার দুটি কারণ জানা যায়। প্রথমত, নীতিনির্ধারকদের অনেকেই মনে করছেন, রোহিঙ্গাদের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করলে তারা হয়তো আর ফিরে যেতে চাইবে না। এমনিতেই শরণার্থী শিবিরের বাইরে গিয়ে অনেকেই খুব সস্তায় দিনমজুরের কাজ করছে, এতে করে স্থানীয় বাসিন্দারা কাজ পাচ্ছে না। তা ছাড়া এরা অন্যান্য কাজে দক্ষতা অর্জন করলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে বলে আশঙ্কা রয়েছে। দ্বিতীয়ত, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের অনেকেই সন্তানদের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা দিতে রাজি নন। যৌথ সাড়াদান কর্মসূচির প্রতিবেদন বলছে, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের লেখাপড়ার সুযোগ বাড়ার পরও ৩ থেকে ১৪ বছর বয়সী ৩৯ শতাংশ শিশু এবং ৯৭ শতাংশ কিশোর-কিশোরী শিক্ষাকেন্দ্রে আসছে না। কিছু অভিভাবক বলেছেন, লেখাপড়া তাঁদের সংস্কৃতির সঙ্গে যায় না।