ছেলেকে দাফন করে হাসপাতালে মেয়ের পাশে তাঁরা

ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মারা যায় মো. রাইয়ান সরকার। ছবি: সংগৃহীত
ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মারা যায় মো. রাইয়ান সরকার। ছবি: সংগৃহীত

১১ বছর ৭ মাস বয়সী ছেলে মো. রাইয়ান সরকার ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে গত শুক্রবার দুপুরে। ছেলের জন্য শোক করার ফুরসত পাননি রাইয়ানের বাবা মমিন সরকার ও মা জান্নাত আরা জাহান। কেননা, ডেঙ্গুতেই আক্রান্ত ছয় বছর বয়সী মেয়ে মালিহা বিনতে সরকার হাসপাতালে ভর্তি। ছেলের বেলাতেও তো চিকিৎসকেরা বলেছিলেন,তার অবস্থা ভালোর দিকে। কিন্তু ছেলেকে বাঁচানো গেল না। এখন মেয়ের অবস্থা চিকিৎসকেরা যা–ই বলেন না কেন, তা বিশ্বাস করতে পারছেন না এই বাবা-মা। এই বাবা আজ মুঠোফোনে কাঁদতে কাঁদতে বললেন, ‘রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে মেয়ে ১১ তলায় কেবিনে ভর্তি। আর ছেলে ছিল সাততলায় এনআইসিইউতে। মেয়ে তার ভাইকে দেখে এসেছিল। এখনো জানে তার ভাইয়া সাততলায় আছে। তাই একটু পরপর বলে, চলো, ভাইয়াকে দেখে আসি। আমরা ছেলের জন্য শোক করব কেমনে? আমাদের মেয়ে তো জানেই না তার ভাইয়া আর নেই। আমরাও তো বিশ্বাস করতে পারছি না সামান্য জ্বরে আমাদের ছেলেটা নাই হয়ে গেল।’

মমিন সরকারের আফসোস আর শেষ হচ্ছে না। ডেঙ্গু কি না, সেই রিপোর্ট পেতে দেরি হয়েছে। হাসপাতালে ভর্তির জন্য বিভিন্ন হাসপাতালে দৌড়াতে গিয়ে সময় নষ্ট হয়েছে। হাসপাতালে ভর্তির আগে ছেলেকে জরুরি বিভাগের সামনে বসিয়ে রাখলেও অন্ততপক্ষে স্যালাইন দিয়ে হলেও যদি চিকিৎসাটা শুরু করা যেত, তাহলে হয়তো ছেলেটা বেঁচে যেত।

মমিন সরকার বললেন, ডেঙ্গু মহামারি আকার ধারণ করেছে। তাহলে হাসপাতালগুলোয় কেন পর্যাপ্ত ব্যবস্থা করা হবে না? আইসিডিডিআরবিতে ডায়রিয়া বা কলেরা রোগী গেলে ক্যাম্পাসের ভেতরের রাস্তায় বিছানা ফেলে দ্রুত চিকিৎসা শুরু করতে পারলে ডেঙ্গুর চিকিৎসায় অন্যান্য হাসপাতাল তা করতে পারবে না কেন? হাসপাতালগুলো তাদের হাসপাতালে কতগুলো সিট খালি আছে, তা বিভিন্ন প্রচারমাধ্যমে প্রচার করতে পারে। তাহলে তো আর রোগী নিয়ে দৌড়াতে হয় না। ডেঙ্গুতে মানুষ দিশেহারা। কোন পরিস্থিতিতে কোথায় যেতে হবে, কী করতে হবে, তা জানতেই পারছে না। সরকার কি প্রচার বাড়াতে পারে না?

রাইয়ান সরকার রাজধানীর সরকারি মোহাম্মদপুর মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিল। মমিন সরকার ফেসবুকে ছেলেমেয়ে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও হাসপাতালে ভর্তি—এ তথ্য জানিয়ে সবার কাছে দোয়া চেয়ে স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন। গত বছর ছেলে পঞ্চম শ্রেণির সমাপনী পরীক্ষায় অংশ নেবে, ভালো ফল করে জীবনের প্রথম ধাপ যাতে ভালোভাবে অর্জন করতে পারে, এ কারণে সবার কাছে দোয়া চেয়েছিলেন। আর এখন তো ছেলে জীবনের সব ধাপই পার করে ফেলল।

হাসপাতালে বসেই মমিন সরকার জানালেন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ছেলেমেয়েকে নিয়ে সংগ্রামের কথা। গত ২৮ জুলাই রাতে জ্বর শুরু হয়েছিল রাইয়ানের। তবে সকাল থেকেই বলছিল, শরীরটা ভালো লাগছে না। জ্বর জ্বর লাগছে। নাপা খাইয়ে ছেলেকে স্কুলে পাঠানো হয়। বলা হয়, শরীর খারাপ লাগলেই শিক্ষকদের বলে যেন ফোন দেয়। ছেলে স্কুলে গিয়ে পেছনে বসে ঘুমিয়ে যায়। স্কুল ছুটির পর নিজেই হাতমুখ ধুয়ে রিকশা নিয়ে শেখেরটেকে বাসায় চলে আসে। বাসায় এসেও বলে শরীর দুর্বল লাগছে। রাতে জ্বর বাড়তে থাকে। সাপোজিটরি দিলে জ্বর কমে, আবার বাড়ে।

২৯ জুলাই সন্ধ্যায় রাইয়ানকে এক শিশু বিশেষজ্ঞের চেম্বারে নিলে জ্বর ১০৫.১৪ ডিগ্রি, অর্থাৎ প্রায় ১০৬ ডিগ্রি হয়ে যায়। চিকিৎসক অন্যান্য রোগী দেখা বাদ দিয়ে চেম্বারেই সাপোজিটরি দেন। ডেঙ্গুর টেস্ট করাতে বলেন। মিরপুরে একটি হাসপাতালে টেস্ট করাতে গেলে চারটা টেস্টের দাম চায় ৩ হাজার ৪৮০ টাকা। এর চেয়েও বড় কথা, তারা জরুরি ভিত্তিতে রিপোর্ট দিতে পারবে না। পরে ছেলেকে নিয়ে কল্যাণপুরে আরেকটি হাসপাতালে যায়। সেখানে টেস্টের দাম রাখে ১ হাজার ৮৪০ টাকা। তারাও পরের দিন ছাড়া রিপোর্ট দিতে পারবে না বলে জানায়।

বাবা-মা ও বোনের সঙ্গে রাইয়ান। ছবি: সংগৃহীত
বাবা-মা ও বোনের সঙ্গে রাইয়ান। ছবি: সংগৃহীত

৩০ জুলাই ডেঙ্গু পজিটিভ বলে রিপোর্ট পাওয়া যায়। তবে এর মধ্যেই ছেলের অবস্থা খারাপ হতে শুরু করে। তবে তখন জ্বর আর নেই। তখন ছেলেকে হাসপাতালে ভর্তির যুদ্ধ শুরু হয়। শংকরে ইবনে সিনা হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানকার চিকিৎসককে দেখানোসহ নানা জায়গায় দৌড়ঝাঁপ করতে করতে বেলা দুইটা বেজে যায়। আত্মীয়স্বজনের মাধ্যমে অন্যান্য হাসপাতালে খবর নিতে থাকেন। তবে সব জায়গা থেকেই খবর পাওয়া যায় সিট খালি নেই। তারপর স্কয়ার হাসপাতালে নেওয়া হয় ছেলেকে। যানজটসহ নানা জটিলতায় এ হাসপাতালে পৌঁছাতে অনেকটুকু সময় নষ্ট হয়। তবে হাসপাতালে যাওয়ার পর দ্রুত চিকিৎসা শুরু করেন চিকিৎসকেরা। দুই ঘণ্টা পরপর নতুন রিপোর্ট দিতে থাকেন। চলতে থাকে যমে মানুষে টানাটানি।

গত ৩১ জুলাই দিবাগত রাত তিনটার দিকে রাইয়ানকে এনআইসিইউতে ভর্তি করা হলো। ছেলের ডেঙ্গু ধরা পড়ার তিন দিন আগে মেয়েরও ডেঙ্গু ধরা পড়েছে। মেয়েরও বমি ও পাতলা পায়খানা শুরু হয়েছে। হাসপাতালে ছেলেকে এনআইসিইউতে ভর্তির পর ছেলের কেবিনেই মেয়েকে ভর্তি করানো হলো।

১ আগস্ট অপেক্ষার পালা শুরু। ছেলেকে লাইফ সাপোর্টে রাখা হলো। আর ২ আগস্ট শুক্রবার জুম্মার নামাজের পর চিকিৎসক ডেকে পাঠালেন। বললেন, অনুমতি পাওয়া গেলে ছেলের ভেন্টিলেশন খুলে ফেলা হবে। এই বাবা-মা যা বোঝার বুঝে গেলেন।

মমিন সরকার বললেন, ছেলে মারা যাওয়ার আগে একবার চিকিৎসক আশা দিয়েছিলেন। কিন্তু বাঁচানো গেল না।

এসিআই কনজ্যুমার ব্র্যান্ডের জোনাল সেলস ম্যানেজার হিসেবে কর্মরত মমিন সরকার জানালেন, তাঁরা প্রতিটি মুহূর্ত কাটাচ্ছেন আতঙ্কের মধ্যে। মেয়েকে সুস্থ করে বাড়ি ফেরার আশায় হাসপাতালে দিন কাটাচ্ছেন রাইয়ানের বাবা-মা।