যেন রয়েছে বঙ্গবন্ধুর স্পর্শ

প্রদর্শনী দেখছেন কয়েকজন দর্শক। ছবি: প্রথম আলো
প্রদর্শনী দেখছেন কয়েকজন দর্শক। ছবি: প্রথম আলো

‘কী দিয়ে তোমায় করবো বরণ/ মোরা যে রিক্ত সর্বহারা/ যাবার আগে বাংলাকে করেছে শ্মশান ওই পাক দস্যুরা।’

কলমের কালিতে গোটা গোটা হরফে লেখা রয়েছে কথাগুলো। ১৩৭৮ বঙ্গাব্দে ময়মনসিংহ মুমিনুননিসা মহিলা কলেজের শিক্ষার্থীরা বঙ্গবন্ধুর হাতে তুলে দিয়েছিলেন বরণপত্র। সেখানেই লেখা এসব কথা। সাদা কাগজের ওপর শাপলার জলছাপের মাঝে একটি অভিনন্দনপত্রে সদ্য স্বাধীন দেশের প্রধানের প্রতি শিক্ষার্থীদের আবেগের প্রকাশটি অনুভব করা যায়। জাতীয় জাদুঘরের নলিনীকান্ত ভট্টশালী গ্যালারিতে আজ শনিবার এক প্রদর্শনীতে পাওয়া গেল এটি।

প্রদর্শনীস্থলে আছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নানান আলোকচিত্র, তাঁর ব্যবহৃত বেশ কিছু স্মৃতিনিদর্শন। আছে তাঁকে দেওয়া বিভিন্ন মানপত্র, মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযুদ্ধ–পরবর্তী সময়ে তাঁকে নিয়ে দেশ-বিদেশের পত্রিকার সংবাদের সচিত্র প্রতিবেদন, রাজনৈতিক থেকে পারিবারিক জীবনের প্রতিচ্ছবিময় আলোকচিত্র, মুজিবকে নিয়ে চিত্রিত চিত্রকর্ম এবং তাঁকে নিয়ে রচিত গ্রন্থসম্ভার। জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে আজ শনিবার থেকে মুজিবময় এই বিশেষ প্রদর্শনীর আয়োজন করেছে জাদুঘর কর্তৃপক্ষ। একই আয়োজনে বঙ্গবন্ধুকে নিবেদিত সেমিনারের আয়োজন করা হয়।

প্রদর্শনীতে রয়েছে বেশ কিছু স্মৃতিনিদর্শন। ছবি: প্রথম আলো
প্রদর্শনীতে রয়েছে বেশ কিছু স্মৃতিনিদর্শন। ছবি: প্রথম আলো

গ্যালারির দেয়ালে টাঙানো থাকা আলোকচিত্রগুলোতে নানা বয়সের শেখ মুজিব যেন মূর্ত হয়ে আছেন। ঈদের নামাজে শামিল হওয়া পিতার সঙ্গে ছোট্ট শেখ রাসেলের ছবিটি মন খারাপ করে দেয়। একটি ছবিতে ১৯৫৩ সালে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনের প্রাক্কালে প্রার্থী মনোনয়নের বৈঠকে তরুণ মুজিব। আরেকটি ছবিতে নিজ পড়ার ঘরে গভীর মনোযোগে বই পড়ছেন বঙ্গবন্ধু। আরেক ছবিতে তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে আলাপচারিতা। অধিকাংশ সাদা-কালো ছবির মাঝে একটি রঙিন ছবিতে বঙ্গবন্ধুর চমৎকার অভিব্যক্তিকে ফ্রেমবন্দী হয়েছেন ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। রাজশাহীর একটি নদীতে শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর নৌকা ভ্রমণের ছবিটি মেলে ধরেছে উভয় নেতার সহজ সম্পর্কের বয়ান। স্মৃতিনিদর্শনের সঙ্গে শতাধিক আলোকচিত্র ও চিত্রকর্মের সঙ্গে গ্রন্থসম্ভারে সাজানো বিশেষ প্রদর্শনীটিতে যেন রয়েছে বঙ্গবন্ধুর স্পর্শ।

বিকেলে জাদুঘরের সংগ্রহশালা থেকে সজ্জিত মাসব্যাপী এ বিশেষ প্রদর্শনীর উদ্বোধন হয়। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ‘দেশগঠনে বঙ্গবন্ধু’ বিষয়ক সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন গবেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক সৌমিত্র শেখর। প্রধান অতিথির বক্তব্য দেন সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ। বিশেষ অতিথি ছিলেন সংস্কৃতিসচিব মো. আবু হেনা মোস্তফা কামাল। সভাপতিত্ব করেন জাতীয় জাদুঘর বোর্ড অব ট্রাস্টিজের সভাপতি শিল্পী হাশেম খান। স্বাগত বক্তব্য দেন জাদুঘরের মহাপরিচালক মো. রিয়াজ আহম্মদ।

প্রধান অতিথির বক্তব্য দেন সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ। ছবি: প্রথম আলো
প্রধান অতিথির বক্তব্য দেন সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ। ছবি: প্রথম আলো

মূল প্রবন্ধে সৌমিত্র শেখর বলেন, ‘দেশগঠনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো সংবিধান প্রণয়ন করা। ১৯৭২ সালের সংবিধানের মূলনীতিগুলো হচ্ছে বাঙালি জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। ১৯৭২ সালের ১৩ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু মন্ত্রিপরিষদের প্রথম সভায় বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা, জাতীয় সংগীত, রণসংগীত নির্ধারণ করা হয়। দেশের পুনর্গঠনে সংবিধান প্রণয়ন, এক কোটি শরণার্থীর পুনর্বাসন, যোগাযোগব্যবস্থা ও সব অবকাঠামোগত উন্নয়নসাধন, শিক্ষাব্যবস্থার সম্প্রসারণ, অসামাজিক কর্ম দমন, মুক্তিযোদ্ধা ও নারীদের পুনর্বাসন এবং কল্যাণে ট্রাস্ট গঠন, কৃষি-শিল্পের সম্প্রসারণ, ব্যাংক-বিমা জাতীয়করণ, ১২১টি দেশের স্বীকৃতি অর্জনসহ নানা পদক্ষেপের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশকে বিশ্বের দরবারে মর্যাদাসম্পন্ন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের ক্ষমতা গ্রহণের আগ পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধবিরোধীরা আধিপত্য বিস্তার করে রেখেছিল। বর্তমানে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের ধারক, তাঁরই তনয়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আলোকবর্তিকা হয়ে আমাদের পথ দেখাচ্ছেন। তাই বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের দেশ গঠন একদিন সুসম্পন্ন হবেই।’

কে এম খালিদ বলেন, বঙ্গবন্ধু দেশগঠনে মাত্র সাড়ে তিন বছর সময় পেয়েছিলেন। কিন্তু এত অল্প সময়ের মধ্যে তিনি দেশগঠনে বেশকিছু যুগান্তকারী পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি, শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিসহ রাষ্ট্রের এমন কোনো শাখা ছিল না যেখানে তাঁর পরিকল্পনার ছাপ ছিল না। তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র সমর্পণ, প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা প্রণয়ন, যুগোপযোগী পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়ন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের নিমিত্ত ‘বাংলাদেশ কোলাবরেটরস স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল অর্ডার’ জারীকরণ, এক বছরেরও কম সময়ের মধ্যে বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নসহ বিভিন্ন যুগান্তকারী পদক্ষেপ ও পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন।’ তিনি বলেন, ‘ভারত আমাদের বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্র। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতের সহযোগিতার কথা বাঙালি জাতি কৃতজ্ঞতাচিত্তে স্মরণ করে। মুক্তিযুদ্ধে ভারতের প্রায় ১১ হাজার সৈন্য নিজেদের প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন। তথাপি পাকিস্তান কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু লন্ডন থেকে ভারত হয়ে বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তনকালে ভারতীয় মিত্রবাহিনীর সদস্যদের অতি দ্রুত সময়ের মধ্যে এদেশ থেকে ফিরিয়ে নিতে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে অনুরোধ করেছিলেন। সে অনুযায়ী অতি অল্প সময়ের মধ্যে ১৯৭২ সালের ১২ মার্চ ভারতীয় বাহিনী বাংলাদেশ থেকে ভারতে প্রত্যাবর্তন করে। বঙ্গবন্ধুর যোগ্য নেতৃত্ব, দক্ষতা ও সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার কারণেই এটা সম্ভব হয়েছিল।

প্রদর্শনী দেখছেন অতিথিরা। ছবি: প্রথম আলো
প্রদর্শনী দেখছেন অতিথিরা। ছবি: প্রথম আলো

সংস্কৃতিসচিব আবু হেনা মোস্তফা কামাল বলেন, বাঙালির আপসহীন নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সোনার বাংলা ও দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর স্বপ্ন দেখেছিলেন। তাঁর স্বপ্ন ছিল শোষণমুক্ত, গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা। শুধু আনুষ্ঠানিকতার বৃত্তে বন্দী না থেকে চিন্তা, মনন ও কর্মে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ধারণ ও তা বাস্তবায়ন করতে পারলেই তাঁর আরাধ্য সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠা সম্ভব।

সভাপতির বক্তব্যে শিল্পী হাশেম খান বলেন, বঙ্গবন্ধু আজ নেই, কিন্তু তাঁর আদর্শকে বাঙালিরা ধারণ করে এ দেশকে উন্নত দেশ হিসেবে পৃথিবীর বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড় করানোর জন্য কাজ করে চলছে।

বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিনিদর্শন, আলোকচিত্র, চিত্রকর্ম এবং বঙ্গবন্ধুর ওপর প্রকাশিত গ্রন্থের প্রদর্শনীটি চলবে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত। শনি থেকে বুধবার সকাল সাড়ে দশটা এবং বিকেল সাড়ে পাঁচটা এবং শুক্রবার বেলা সাড়ে তিনটা থেকে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা পর্যন্ত খোলা থাকবে। বৃহস্পতিবার সাপ্তাহিক ছুটির দিনে প্রদর্শনী বন্ধ থাকবে।