মাসে গড়ে ৩৪ শিশু খুন

চলতি বছরের প্রথমার্ধে গড়ে মাসে ৩৪ শিশুর বেশি খুন হয়েছে। খুনের শিকার অর্ধেকের বেশি শিশুর বয়স ১২ বছরের নিচে। গত সাড়ে চার বছরে হত্যার শিকার মোট শিশুর সংখ্যা দেড় হাজারের বেশি।

পারিবারিক সহিংসতা, অপহরণ ও ধর্ষণের কারণে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক শিশুহত্যার ঘটনা ঘটেছে। শিশুদের নিয়ে কাজ করেন এমন ব্যক্তিরা বলছেন, শিশুহত্যার সংখ্যা ও ধরন উদ্বেগজনক। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, বিচারহীনতা ও পারিবারিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কারণে শিশুহত্যা বাড়ছে।

বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের (বিএসএএফ) বছরওয়ারি পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে এই তথ্য পাওয়া গেছে। ১০টি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে হিসাব রাখে সংগঠনটি। বিএসএএফ শিশু অধিকার বিষয়ে কাজ করে এমন ২৬৯টি বেসরকারি সংস্থা বা এনজিওগুলোর জাতীয় নেটওয়ার্ক।

বিএসএএফের গত সাড়ে চার বছরের পরিসংখ্যান বলছে, শিশুহত্যা বাড়ছে। ২০১৯ সালের প্রথম ছয় মাসে মোট ২০৫টি শিশু হত্যার শিকার হয়েছে। ২০১৮ সালে সে সংখ্যা ছিল ৪১৮, এর আগের বছর ছিল ৩৩৯। আগেও শিশুহত্যার একই প্রবণতা দেখা গেছে।

দেশ বড় ধরনের বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে উল্লেখ করে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক শীপা হাফিজা প্রথম আলোকে বলেন, সহিংসতার ধরন দিন দিন ভয়ংকর হচ্ছে। মানুষ বেপরোয়া হচ্ছে, কোনো অপরাধ করতেই দ্বিধা করছে না। অপরাধ কমাতে শাস্তি দ্রুত ও দৃশ্যমান করতে হবে।

চলতি বছরের হত্যার শিকার শিশুদের মধ্যে ৮০ শতাংশ শিশুর বয়সের হিসাব পাওয়া গেছে। এতে দেখা যায়, এদের মধ্যে ৫৬ শতাংশ শিশুর বয়স ১২ বছরের কম। অর্থাৎ, এই বয়সী মোট ৯৩টি শিশুকে আর ১৩ থেকে ১৮ বছরের ৭২টি শিশুকে হত্যা করা হয়েছে।

বিএসএএফের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, সবচেয়ে বেশি খুনের ঘটনা ঘটেছে ঢাকা জেলায়—২৪ শিশু। এরপর সিলেটে ১২, ময়মনসিংহে ১০ এবং বরিশাল, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুমিল্লা, গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জে ৭টি করে শিশু খুন হয়েছে।

নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে মাল্টি-সেক্টরাল কার্যক্রম চলছে। কিন্তু শিশু নির্যাতন বন্ধে এই কার্যক্রমের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। এই কার্যক্রমের পরিচালক আবুল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, সার্বিক কার্যক্রমের অংশ হিসাবে প্রশিক্ষণ, কর্মশালা, উঠান বৈঠকের মাধ্যমে শিশু নির্যাতন রোধে সচেতন করা হয়। তবে সরাসরি শিশুদের সুরক্ষার বিষয়ে সে রকম কর্মসূচি নেই। তবে সহিংসতার শিকার কেউ সহায়তা চাইলে বা নজরে এলে সে শিশুর সুরক্ষা দেওয়া হয়। সহিংসতার শিকার বা আশঙ্কা থাকলে হেল্পলাইন ‘১০৯’–এ কল করার পরামর্শ দেন তিনি।

রাজধানীর ওয়ারীর সাত বছরের শিশু সামিয়া আক্তার সায়মাকে ধর্ষণের পর শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়েছে। হত্যার দায়ে অভিযুক্ত হারুন অর রশীদ আদালতকে জানান, ধরা পড়া ঠেকাতে ধর্ষণ শেষে শিশুটিকে হত্যা করেন তিনি। ঘটনাটি গত ২৫ জুলাইয়ের।

প্রথম আলো ঢাকা জেলার পাঁচটি নারী নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে প্রায় ১৫ বছরের (২০০২-১৬) ধর্ষণসংক্রান্ত পাঁচ হাজারের মতো মামলার পরিস্থিতি অনুসন্ধানে দেখা যায়, ধর্ষণজনিত মৃত্যু ও হত্যার ২১ শতাংশ মামলা ১১ থেকে ১৫ বছর ধরে ঝুলেছিল। আর ধর্ষণসংক্রান্ত নিষ্পত্তি হওয়া মামলাগুলোর মাত্র ৩ শতাংশের সাজা হয়েছে।

>গত সাড়ে চার বছরের পরিসংখ্যান বলছে, শিশুহত্যা বাড়ছে
চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে ২০৫টি শিশু খুন
হত্যার শিকার ৫৬ শতাংশ শিশুর বয়স ১২ বছরের কম
সহিংসতার ধরন দিন দিন ভয়ংকর হচ্ছে।

মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) নিয়মিত মানবাধিকার প্রতিবেদনেও শিশুহত্যার একই চিত্র উঠে এসেছে। হিসাব বলছে, প্রথম ছয় মাসে হত্যার শিকার হয়েছে ২০৩টি শিশু। এর ৭৮টি ঘটনায় মামলা হয়েছে। ৯টি জাতীয় দৈনিক পত্রিকার সংবাদ ও নিজস্ব অনুসন্ধানের ভিত্তিতে আসক প্রতি মাসে এমন প্রতিবেদন তৈরি করে।

বিএসএএফের তথ্য আরও বলছে, হত্যার শিকার শিশুদের মধ্যে মেয়েদের তুলনায় ছেলের সংখ্যা দ্বিগুণ। খুন হওয়া ২০৫টি শিশুর মধ্যে ১৩২টি ছেলেশিশু। পারিবারিক সহিংসতা, অপহরণের পরে হত্যা, শারীরিক নির্যাতনের পর হত্যা, ধর্ষণের পর হত্যা, ধর্ষণে ব্যর্থ হয়ে হত্যা, কিশোরদের মধ্যে প্রভাব বিস্তার, খেলা নিয়ে গোলমাল বেধে বেশির ভাগ হত্যাকাণ্ড ঘটেছে।

সাতক্ষীরার কালীগঞ্জ উপজেলায় এক দম্পতির মধ্যে বেশ কিছুদিন ধরেই ঝগড়া চলছিল। এর জের ধরে বাবার বাড়ি চলে যান স্ত্রী। স্ত্রীকে ফিরিয়ে আনতে শ্বশুরবাড়িতে আসেন স্বামী। সেখানেও তাঁদের মধ্যে ঝগড়া বাধে। স্বামী ক্ষিপ্ত হয়ে একপর্যায়ে সাত মাস বয়সী ছেলেকে নলকূপের সঙ্গে আঘাত করেন। এতে শিশুটির মৃত্যু হয়। ঘটনাটি ২০১৭ সালের ২৭ নভেম্বরের।

স্বামী-স্ত্রী একে–অপরকে নির্যাতন বা প্রতিশোধ নেওয়ার স্পৃহা থেকে মা–বাবার দ্বারা হত্যার ঘটনা ঘটছে বলে মন্তব্য করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক নেহাল করিম। তিনি বলেন, হত্যার বিষয়টি সব সময় পরিকল্পিত নয়। স্বামী-স্ত্রী একে–অপরকে সন্দেহ ও বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কের কারণে এমন ঘটনা বাড়ছে। এসব সামাজিক অপরাধপ্রবণতা নিয়ে মনোসামাজিক বিশ্লেষণ ও গবেষণা জরুরি বলে মত দেন তিনি।

৫০ হাজার টাকা মুক্তিপণের আশায় প্রতিবেশীদের হাতে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জে পাঁচ বছরের রিফাত হোসেন প্রথমে অপহরণ, পরে খুন হয়। ঘটনাটি গেল বছরের জানুয়ারির।

মানবাধিকারকর্মী নূর খান বলেন, বিচারহীনতা ও অপহরণের ঘটনা বৃদ্ধির সঙ্গে হত্যার সংখ্যা সম্পর্কিত। অপরাধীরা ধরা পড়ার ঝুঁকি নিতে চায় না বলেই অপহরণের পর শিশুদের হত্যা করে। অপরাধ রোধে দ্রুত বিচার কার্যকর ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ইতিবাচক পরিবর্তন জরুরি।