অযত্নে বেহাল মৌলভীবাজারের 'বেরি লেক'
অনেক দিন ধরেই মৌলভীবাজার শহরের বুকে প্রাকৃতিকভাবে তৈরি হওয়া হ্রদ ‘বেরি লেক’ নিয়ে নানা প্রকল্প-পরিকল্পনার কথা শোনা যাচ্ছে। কিন্তু সময় গড়িয়ে গেছে শুধু। প্রাকৃতিক এই হ্রদের সুরক্ষা, সৌন্দর্যবর্ধন ও উন্নয়নে কোনো কার্যক্রম বাস্তবায়িত হয়নি।
গত মঙ্গলবার সরেজমিনে দেখা গেছে, ঢাকা-সিলেট আঞ্চলিক মহাসড়ক দিয়ে মৌলভীবাজার শহরে ঢুকতে গেলেই এই হ্রদ চোখে পড়ে। মহাসড়কের পূর্ব পাশে এবং শহরের ভেতর দিয়ে চলে যাওয়া শাহ মোস্তফা সড়কের উত্তর পাশে পড়েছে হ্রদটি। হ্রদটির উত্তর পাশে বেরির চর নামে একটি পাড়াই গড়ে উঠেছে। অনেকগুলো উঁচু দালান সেখানে উঁকি দিয়ে আকাশ ছুঁতে চাইছে। লেকটির পাড়ে নানা ময়লা-আবর্জনা ফেলে রাখা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন রকম পানীয়ের বোতল, খাবারের প্লাস্টিকের বাক্স ও প্যাকেট, টুকরা চটের বস্তা, চিপস-চানাচুরের প্যাকেট ইত্যাদি। কোথাও আছে ইটের টুকরা-টাকরা অংশ। পাড় ঘেঁষে গজিয়েছে বিভিন্ন জাতের জলজ ঘাস, কচুরিপানা ও আগাছা। লেকের দক্ষিণ পাড়ে অনেকগুলো ট্রাক দাঁড়ানো। সিএনজিচালিত অটোরিকশাসহ কিছু গাড়ি হ্রদের পানি দিয়ে ধোয়ামোছা করা হচ্ছে।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, বেরি লেকের এই এলাকা এক সময় মৌলভীবাজার শহরের উত্তর পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া মনু নদের সঙ্গে যুক্ত ছিল। কারও মতে, কোনো একসময় বড় রকমের ভূমিকম্প হলে বর্তমান বেরি লেকের অংশটি মনু নদ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। বিচ্ছিন্ন এই অংশই এখানে হ্রদের আকার নিয়েছে, যা মৌলভীবাজারবাসীর কাছে ‘বেরি লেক’ নামেই পরিচিতি পেয়ে আসছে।
মৌলভীবাজার পৌরসভা সূত্রে জানা গেছে, বেরি লেকটি অতীতে উপজেলা পরিষদের (প্রাক্তন থানা পরিষদ) অধীন ছিল। বদ্ধ জলাশয় আইন (২০ একর পর্যন্ত পৌরসভার অধীনে থাকবে) অনুযায়ী ১৯৮৭ সাল থেকে বেরি লেক মৌলভীবাজার পৌরসভার আওতায় চলে আসে। বেরি লেকের আয়তন হচ্ছে ১৪ একর ৬৫ শতক। পৌরসভার আওতায় আসার পর থেকেই সরকারি নিয়ম অনুযায়ী মৎস্য চাষের জন্য বেরি লেকটিকে ইজারা প্রদান করা হচ্ছে। এদিকে নব্বইয়ের দশকের শুরুতে বেরি লেকের দুই পাড়ে মার্বেল পাথর দিয়ে পায়ে চলার পথ তৈরির একটি উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল, যাতে শহরের মানুষ এখানে এসে স্বাস্থ্যকর পরিবেশে হাঁটাহাঁটি করতে পারে। কিন্তু সেই উদ্যোগ আর বাস্তবায়িত হয়নি।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) মৌলভীবাজার জেলার সমন্বয়ক আ স ম ছালেহ সুহেল প্রথম আলোকে বলেন, সবার আগে এখন যেটা দরকার, বেরি লেকের দূষণ ও দখল রোধ করা। একসময় বেরি লেকের পাড়ে পার্ক ছিল, সেটা উচ্ছেদ হয়েছে। এখন সেখানে ট্রাকস্ট্যান্ড, ছাগলের হাট বসছে। এটা কোনোভাবেই লেকের সঙ্গে যায় না। লেক নিয়ে সব সময় হেলাফেলা হয়েছে। কখনোই পরিবেশ ও সৌন্দর্যের বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। এ বিষয়ে লেকের অভিভাবক যাঁরা, তাঁদের দৃঢ় অবস্থান নিতে হবে। বেরি লেক নিয়ে সুদূরপ্রসারী প্রকল্প গ্রহণ দরকার।
এদিকে মৌলভীবাজার পৌরসভার পক্ষ থেকে বছরখানেক আগে বেরি লেক উন্নয়নের লক্ষ্যে একটি প্রকল্প পরিকল্পনা প্রধানমন্ত্রীর কাছে জমা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সে প্রকল্প কী পর্যায়ে আছে, তা কেউ বলতে পারছে না। প্রকল্পের মধ্যে ছিল বেরি লেকের দুই পাশে সীমানাপ্রাচীর নির্মাণ, গাইড ওয়াল স্থাপন, হ্রদের পানি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার ব্যবস্থা, অবৈধ দখল উচ্ছেদ, চতুর্দিকে নালা নির্মাণ করা, দুই পাড়ে পায়ে হাঁটার পথ তৈরি করা ইত্যাদি।
পৌরসভার মেয়র ফজলুর রহমান বলেন, ‘ঢাকার হাতিরঝিলের মতো দৃষ্টিনন্দন করে বেরি লেকের উন্নয়নের লক্ষ্যে প্রায় এক বছর আগে প্রধানমন্ত্রীর কাছে একটি প্রকল্প প্রস্তাব জমা দিয়েছিলাম। সেটি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সচিবের কাছে পাঠানো হয়। সচিব স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইিড) প্রধান প্রকৌশলীর কাছে পাঠিয়ে দেন। সেই অবস্থাতেই আছে। বেরি লেক নিয়ে আর কোনো অগ্রগতি নেই।’