বৃষ্টিটাই বাধাল গোল, ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকা

বৈরী আবহাওয়া থাকায় ১৭ ঘণ্টা বন্ধ থাকার পরে মাদারীপুরের কাঁঠালবাড়ি ও মুন্সিগঞ্জের শিমুলিয়া নৌপথে শুরু হয়েছে ফেরি চলাচল। দীর্ঘ সময় ফেরি চলাচল বন্ধ থাকায় ঘাটে আটকা পড়েছে কয়েক শ যানবাহন। ছবি: অজয় কুণ্ডু
বৈরী আবহাওয়া থাকায় ১৭ ঘণ্টা বন্ধ থাকার পরে মাদারীপুরের কাঁঠালবাড়ি ও মুন্সিগঞ্জের শিমুলিয়া নৌপথে শুরু হয়েছে ফেরি চলাচল। দীর্ঘ সময় ফেরি চলাচল বন্ধ থাকায় ঘাটে আটকা পড়েছে কয়েক শ যানবাহন। ছবি: অজয় কুণ্ডু

পবিত্র ঈদুল আজহায় এবার লম্বা ছুটি রয়েছে। আজ বৃহস্পতিবারের পর কাল শুক্রবার থেকে শুরু হবে ছুটি। তবে অনেকে এক–দুদিন আগেই ঢাকা ছাড়তে চাইছেন। তেমনই একজন শেখ শরিফুল হক। গতকাল বুধবার রাতেই বাড়ির উদ্দেশে রওনা হওয়ার কথা ছিল তাঁর। বাস ছাড়ার সময় ছিল রাত সাড়ে ১০টা। তবে নির্ধারিত সময়ে সাতক্ষীরা এক্সপ্রেস পরিবহনের ওই বাস ঢাকা ছাড়তে পারেনি। বৃষ্টিসহ দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার জন্য এ পরিস্থিতি।

গতকাল রাতে বাসটি রাজবাড়ীর দৌলোদিয়া ফেরিঘাটে আটকে নির্ধারিত সময় ঢাকাতেই পৌছাতে পারেনি। দীর্ঘ আট ঘণ্টা অপেক্ষার পর আজ ভোররাত চারটায় ফেরি পার হয় বাসটি। এরপর সকাল ৭টা ১০ মিনিটে ঢাকায় আসে। সারা রাত পার করে ওই বাসে করে আজ সকাল সাড়ে সাতটায় সাতক্ষীরায় রওনা দেন শরিফুল হক।

শরিফুল হক আজ সকালে প্রথম আলোকে বলেন, ‘রাতে কাউন্টার থেকে জানিয়ে দেওয়া হয় বাস ছাড়তে দেরি হবে। পরে বলা হয়, সকালবেলা বাস আসবে। আট ঘণ্টা পর ঢাকা ছাড়তে পেরেছি। কখন গিয়ে পৌঁছাব, বুঝতে পারছি না।’

বাসের চালক হাবিবুল্লাহ বলেন, ‘গতকাল বিকেল চারটায় একেবারে ফাঁকা বাস নিয়ে সাতক্ষীরা থেকে রওনা হয়েছিলাম। রাত আটটার দিকে দৌলতদিয়া ফেরিঘাটে আসি। কিন্তু লম্বা লাইনের কারণে ফেরি পায়নি। গরুবোঝাই শত শত ট্রাক। সিরিয়াল পেতে অনেক দেরি হয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত আট ঘন্টা অপেক্ষা করে ভোররাত চারটায় ফেরিতে উঠি।’ তিনি আরও বলেন, বৃষ্টি ও নদীতে প্রচণ্ড স্রোতের কারণে এগুলো খুব ধীরে পার হচ্ছে। এর মধ্যে আবার কোরবানির জন্য প্রচুর গরুর ট্রাক ঢাকার দিকে যাচ্ছে। সব মিলিয়ে এই অবস্থা চলছে।

ঈদ যত এগিয়ে আসছে, গাবতলী বাস টার্মিনালে যাত্রীদের চাপ তত বাড়ছে। এই চাপে পরিবহন–সংশ্লিষ্টরা দুশ্চিন্তার মধ্যে পড়েছেন। হানিফ পরিবহনের ব্যবস্থাপক মোশারফ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, আজ তাঁদের প্রায় ২০০টি বাস উত্তরাঞ্চলের দিকে রওনা হবে। বৃষ্টির কারণে প্রতিটি বাস দেরি করে ঢাকায় আসছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দক্ষিণবঙ্গের সড়কপথে চলাচলকারী একটি বাস কোম্পানির কর্ণধার বলেন, ‘গতকাল রাতে দৌলতদিয়া থেকে পাটুরিয়া রুটে খুব কম ফেরি চলাচল করেছে। যেগুলো চলেছে, সেগুলোয় কোরবানির পশুবাহী ট্রাকের সংখ্যা বেশি। এর মধ্যে গতকাল থেকে শুরু হয়েছে বৃষ্টি।’

আবহাওয়া দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, গতকাল সন্ধ্যা ছয়টা থেকে আজ সকাল নয়টা পর্যন্ত রাজধানীতে ৫১ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। গতকাল সন্ধ্যা ছয়টা থেকে আজ সকাল ছয়টা পর্যন্ত ১২ ঘণ্টায় সবচেয়ে বেশি বৃষ্টি হয়েছে হাতিয়ায়, ৬৯ মিলিমিটার।

বৃষ্টিমুখর এই আবহাওয়া আরও কয়েক দিন চলবে জানিয়ে আবহাওয়া অধিদপ্তরের পরিচালক শামছুদ্দীন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, আজ দুপুরের পর থেকে ভারী বৃষ্টির মাত্রা কমে আসবে। ঝিরিঝিরি বা হালকা থেকে মাঝারি ধরনের বৃষ্টি চলতেই থাকবে। এখন বর্ষাকাল। মৌসুমী বায়ু বেশ সক্রিয়। এর সঙ্গে একটি নিম্নচাপ ভারতের ওডিশা উপকূল দিয়ে আঘাত হেনেছে। সেটির প্রভাবে গত দুদিন ভারী বৃষ্টি হয়েছে। তিনি বলেন, কাল শুক্রবার এবং পরদিন শনিবার বৃষ্টি হয়তো কিছুটা কমবে। এরপর আবারও ১৫ আগস্ট পর্যন্ত সারা দেশেই বৃষ্টির প্রবণতা থাকবে।

আজ সকালে মানিকগঞ্জের শিবালয়ের পাটুরিয়া ঘাট এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, ঘরমুখী মানুষ ও যানবাহনের বেশ চাপ রয়েছে। আজ বেলা ১১টার দিকে পাটুরিয়া প্রান্তে যাত্রীবাহী শতাধিক বাস, দুই শতাধিক ব্যক্তিগত গাড়ি এবং পণ্যবাহী আড়ই শ ট্রাক পারাপারের অপেক্ষা থাকতে দেখা গেছে। দুপুরে পর থেকে যানবাহন ও যাত্রীর চাপ আরও বাড়বে বলে জানিয়েছে ঘাটসংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র।

বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন সংস্থার (বিআইডব্লিউটিসি) আরিচা কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, সকাল থেকে থেমে থেকে বৃষ্টি হচ্ছে। বাতাসের বেগ কিছুটা বেশি থাকায় পদ্মা নদীতে ঢেউয়ের সৃষ্টি হয়েছে। এ ছাড়া পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া নৌপথে রয়েছে তীব্র স্রোত। এতে স্বাভাবিক অবস্থার চেয়ে সময় কিছুটা বেশি লাগছে। এ কারণে ফেরির ট্রিপ সংখ্যাও কমেছে।

বর্তমানে এই নৌপথে ১৯টি ফেরির মধ্যে একটি বিকল হওয়ায় ১৮টি দিয়ে যানবাহন ও যাত্রী পারাপার করা হচ্ছে। আজ রাতের মধ্যে আরেকটি ফেরি এখানে আসার কথা রয়েছে।

কাবেরী ফেরির মাস্টার শিপুপ্রসাদ দাস প্রথম আলোকে বলেন, ‘আগে পাটুরিয়া থেকে দৌলতদিয়া যেতে ৩০ মিনিটের মতো সময় লাগত। নদীতে তীব্র স্রোতের কারণে এখন ৫০ মিনিটের মতো সময় লাগছে। স্রোতের বিপরীতে কুলিয়ে উঠতে ফেরির ইঞ্জিনের ওপর প্রচণ্ড চাপ পড়ছে।’

১৭ ঘণ্টা বন্ধ থাকার পর মাদারীপুরের কাঁঠালবাড়ি ও মুন্সিগঞ্জের শিমুলিয়া নৌপথে ফেরি চলাচল শুরু হয়েছে। আজ সকাল ছয়টা থেকে ১৮টি ফেরির বিপরীতে থেমে থেমে চলছে মাত্র ৭টি। পদ্মায় ২ নম্বর বিপৎসংকেত থাকায় লঞ্চ ও স্পিডবোট চলাচল বন্ধ রাখা হয়েছে। তবে এখনো প্রবল স্রোত আর বাতাস থাকায় চাহিদা অনুসারে ফেরি চালানো সম্ভব হচ্ছে না।

বৈরী আবহাওয়ার কারণে গতকাল বেলা একটা থেকে ফেরিসহ সব ধরনের নৌযান চলাচল সাময়িক বন্ধ ঘোষণা করে ঘাট কর্তৃপক্ষ। হঠাৎ নৌযান চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বিপাকে পড়েন যাত্রী ও পরিবহনচালকেরা। পদ্মা পারাপারের অপেক্ষায় অনেক যাত্রীরা দুর্ভোগ আর বৃষ্টি মাথায় নিয়ে রাত কাটিয়েছেন ঘাটে। গন্তব্যে পৌঁছাতে না পেরে অনেকেই ঘাটে এসে আবার ফিরে গেছেন। অন্যদিকে, ফেরি চলাচল কম থাকায় ঘাটে আটকা পড়েছে গরুবোঝাই শতাধিক ট্রাক। ঠিক সময়ে পদ্মা নদী পাড়ি দিতে না পারায় গরুর ব্যাপারীরা লোকসানের আতঙ্কে রয়েছেন।

পদ্মায় ফেরি চলাচল ব্যাহত থাকায় দুই ঘাটেই এক হাজারেরও বেশি যানবাহন আটকা পড়েছে। বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন সংস্থার (বিআইডব্লিউটিসি) কাঁঠালবাড়ি ঘাটের ব্যবস্থাপক জসিম উদ্দিন শিকদার প্রথম আলোকে বলেন, ‘দীর্ঘ সময় বন্ধ থাকার পর আমরা সকাল ছয়টা থেকে ফেরি চলাচল শুরু করেছি। পদ্মায় এখনো প্রবল স্রোত ও বাতাস বইছে। তবে তা গতকালের চেয়ে কম। তাই আমরা ১৮টি ফেরির বিপরীতে ৭টি ফেরি চালাতে সক্ষম হয়েছি। এখনো স্রোত আর বাতাস থাকায় পদ্মায় চ্যানেল ঘুরে শিমুলিয়া যেতে প্রতিটি ফেরির দ্বিগুণ সময় ব্যয় হচ্ছে।’

সরেজমিনে দেখা যায়, কাঁঠালবাড়ির চারটি ঘাটেই যানবাহনের দীর্ঘ সারি। ঘাটের চারপাশে যাত্রীদের চাপ রয়েছে। সকাল থেকে থেমে থেমে কয়েকবার বৃষ্টি হওয়ায় অনেকেই ঘাট এলাকার যাত্রীছাউনিতে আশ্রয় নিয়েছেন। ঘাটের সংযোগ সড়কগুলোয় যানবাহনের দীর্ঘ সারি। লঞ্চ ও স্পিডবোটগুলো ঘাটে নোঙর করে রাখা রয়েছে।

ঢাকাগামী যাত্রী শিকদার মামুন বলেন, ‘রাতে মাদারীপুর থেকে রওনা দিয়ে ঘাটে গেছি। সারা রাত ফেরির অপেক্ষায় ঘাটে বসে থাকতে হয়েছে। সকাল সাতটার দিকে দুর্ভোগ আর বৃষ্টি মাথায় নিয়ে অনেক কষ্টে ফেরিতে উঠতে পেরেছি।’

নড়াইল থেকে ছেড়ে আসা গরুবোঝাই ট্রাকের ব্যাপারী সাইদুর হক বলেন, ‘বুধবার বিকেল থেকে ফেরির অপেক্ষায় ঘাটে বসে আছি। রাতে একটি ফেরিও চলে নাই। বৃহস্পতিবার সকালে গরুর ট্রাক নিয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে আছি। কখন পারাপার হতে পারব, তা কেউ বলতে পারছে না। যথাসময় হাট না ধরতে পারলে বড় লোকসান হয়ে যাবে আমাদের।’

আজ সকাল সাড়ে আটটার দিকে বিআইডব্লিউটিএ কাঁঠালবাড়ি লঞ্চঘাটের ট্রাফিক পরিদর্শক আক্তার হোসেন বলেন, ‘গতকাল থেকে পদ্মায় দমকা হাওয়া আর স্রোত থাকায় আমরা লঞ্চ ও স্পিডবোট চলাচল বন্ধ রেখেছি। আজ সকালেও গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি। আমরা একটি লঞ্চও টার্মিনাল থেকে ছাড়িনি। এ ছাড়া বিআইডব্লিউটিএর পক্ষ থেকে নৌযান চলাচলে সতর্ক থাকতে ২ নম্বর বিপৎসংকেত দেখানো হয়েছে।’