পালিচড়ার ফুটবল কন্যারা

দারিদ্র্যের কশাঘাতে জর্জরিত একেকটা পরিবার। ছিল সমাজপতিদের শাসানি। বখাটেদের উৎপাতও সইতে হয়েছে। এত কিছুর পরও দমেনি কিশোরীর দল। একাগ্রচিত্তে অনুশীলন করে গেছে। জার্সি গায়ে, বুট পায়ে মাঠে নেমেছে। এখন তারা জাতীয় পর্যায়ে চ্যাম্পিয়ন। ছিনিয়ে আনছে একের পর এক সাফল্য। কলসিন্দুরের মতোই ফুটবল রাঙাচ্ছে রংপুরের পালিচড়ার এই মেয়েরা।

সম্প্রতি জেএফএ কাপ অনূর্ধ্ব-১৪ নারী ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে পালিচড়ার মেয়েরা। গোটা দলটাই উঠে এসেছে রংপুর সদরের একটি গ্রাম থেকে। বর্তমানে সেখানে নারী ফুটবলারই আছে ২৭ জন।

পালিচড়ায় ফুটবল–বিপ্লব

২০১১ সালের কথা! বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা প্রাথমিক স্কুল ফুটবল টুর্নামেন্টে নাম লেখায় ১ নম্বর পালিচড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। সেবার জাতীয় পর্যায়ে রানার্সআপ হয় পালিচড়ার মেয়েরা। ওই টুর্নামেন্টের পর থেকেই গ্রামের মেয়েদের ফুটবলের নেশা পেয়ে বসে।

শুরুতে মেয়েরা লুকিয়ে মাঠে আসত। এলাকার মুরব্বি ও মৌলভিরা বলতেন, ‘ছেলেদের মতো হাফপ্যান্ট (শর্টস) পরে মেয়েরা কেন ফুটবল খেলবে?’ পাড়ার বখাটেদের উৎপাতও কম ছিল না। অভিভাবকদেরও ছিল না ততটা উৎসাহ।

জাতীয় দলের অন্যতম খেলোয়াড় ও পালিচড়ার ১১ কিশোরীর একজন সিরাত জাহান। তার মা লিপি বেগম বললেন, ‘ফুটবল খেলত বলে মেয়েকে বিয়ে দিয়ে দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু হারুন ভাই (কোচ হারুন অর রশীদ) এসে বললেন, “এই মেয়ের দায়িত্ব আমি নিচ্ছি। ওকে আমার হাতে তুলে দেন।” আমি না করতে পারিনি। এখন আমার মেয়ে জাতীয় দলে খেলছে।’

শুধু সিরাতের মা নন, ইশরাত জাহানের মা রোজিফা বেগমও প্রথম দিকে মেয়েকে খেলতে দিতে চাননি। তাঁর কথায়, ‘আমার মেয়ে সারাক্ষণ ছেলেদের সঙ্গে ফুটবল খেলত। এসব দেখে আমি ওকে গালিগালাজ করতাম। ফুটবল খেলত বলে অন্য স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছিলাম। কিন্তু মিলন ও হারুন ভাইয়েরা গিয়ে আবারও ওকে ফিরিয়ে আনেন।’

কিশোরীদের মাঝে একদিন

রংপুর শহর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে পালিচড়া গ্রাম। গ্রামের এক কোণে পাশাপাশি দুটি স্কুল। একটি পালিচড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, অন্যটি পালিচড়া এমএন উচ্চবিদ্যালয়। ছুটির ঘণ্টা বাজতেই স্কুল দুটি থেকে বেরিয়ে এল জার্সি পরা মেয়েরা। হাতে ফুটবল, কাঁধে ব্যাগ নিয়ে গোলপোস্টের নিচে বসে পড়ল শামীমা আক্তার, ঝর্ণা খাতুনেরা। অনুশীলনে নামার আগে পরে নিল বুট। চুলগুলো বেঁধে নিল লম্বা বেনি করে।

অনুশীলনে ব্যস্ত রংপুরের পালিচড়ার ফুটবল-কন্যারা। ছবিটি সম্প্রতি তোলা।  মঈনুল ইসলাম
অনুশীলনে ব্যস্ত রংপুরের পালিচড়ার ফুটবল-কন্যারা। ছবিটি সম্প্রতি তোলা। মঈনুল ইসলাম

কোচ মিলন খান ততক্ষণে অনুশীলন সরঞ্জাম স্পেস মার্কারও কোন নিয়ে প্রস্তুত। বাঁশিতে ফুঁ দিতেই মেয়েরা নেমে গেল ফুটবল অনুশীলনে। এরাই গত ১৯ জুলাই ঢাকায় চ্যাম্পিয়নের ট্রফি হাতে উৎসব করেছে। জেএফএ কাপ অনূর্ধ্ব-১৪ নারী ফুটবলের ফাইনালে সেদিন রংপুর জেলা হারিয়েছিল ময়মনসিংহকে। শুধু দলের নামটাই ছিল রংপুর, নইলে এই জেলার সব ফুটবলারই উঠে এসেছে সদর উপজেলার সদ্যপুষ্করিণী ইউনিয়নের পালিচড়া গ্রাম থেকে। এই গ্রাম থেকে উঠে এসে বর্তমানে জাতীয় ও বিভিন্ন বয়সভিত্তিক দলে খেলছে নয়জন ফুটবলার। সর্বশেষ জাতীয় দলে ডাক পেয়েছে শামীমা আক্তার। সিরাত জাহান, মিশরাত জাহানদের পথ ধরে পালিচড়া হয়ে উঠেছে রীতিমতো নারী ফুটবলের এক গ্রাম।

সাফল্যের ঝুলি

গত আট বছরে পালিচড়া গ্রামের মেয়েদের সাফল্যের তালিকাটি বেশ লম্বা। ২০১২ ও ২০১৪ সালে বঙ্গমাতা স্কুল ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন, ২০১৫ সালে চ্যাম্পিয়ন ব্র্যাক কিশোরী ফুটবল টুর্নামেন্টে। ২০১৪ সালে ৪৭তম জাতীয় স্কুল মাদ্রাসা প্রতিযোগিতায়ও শিরোপা জেতে তারা। ২০১৫ সালে কেএফসি জাতীয় মহিলা চ্যাম্পিয়নশিপের চূড়ান্ত পর্বে ওঠে এই মেয়েরা। চ্যাম্পিয়ন হতে না পারলেও জিতেছিল ফেয়ার-প্লে ট্রফি।

অভাবের সংসারে আলো

ফুটবল খেলত বলে মায়ের বকুনি খাওয়া সেই ইশরাত জাহান এখন সংসারের হাল ধরেছে। তাদের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেল, চারদিকে দারিদ্র্যের ছাপ। আধপাকা ঘরের অর্ধেকটা টিনের বেড়া। বাকি অর্ধেক বাঁশের। কাঠের দরজায় সাঁটা বঙ্গমাতা আন্তর্জাতিক গোল্ডকাপ টুর্নামেন্টের পোস্টার। সেখানে পালিচড়ার পাঁচ ফুটবলারের সঙ্গে ইশরাতের ছবিও আছে। বাবা বাদশা মিয়া গত বছর ক্যানসারে মারা গেছেন। চার মেয়েকে নিয়ে যখন চোখে সরষে ফুল দেখছিলেন রোজিফা বেগম, তখনই ফুটবলার মেয়ে তাঁকে দিয়েছে আলোর দিশা। গত বছর সাফ অনূর্ধ্ব-১৮ নারী ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল বাংলাদেশ। অন্য খেলোয়াড়দের মতো ইশরাতও পেয়েছিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেওয়া ১০ লাখ টাকা অর্থ পুরস্কার। সেই টাকা থেকে ৩ লাখ টাকায় মায়ের চিকিৎসা করিয়েছে ইশরাত। বাকি ৭ লাখ টাকা ব্যাংকে জমা রেখেছে। ইশরাতের ছোট বোন নুসরাত জাহানও খেলছে জাতীয় দলে।

দুই মেয়েকে নিয়ে মায়ের গর্বের শেষ নেই, ‘মেয়েরা যখন বাড়ি এসে আমার হাতে টাকা তুলে দেয়, কী যে ভালো লাগে! আমার ছেলে নেই, কিন্তু এখন এসব নিয়ে দুঃখ করি না। ওরাই আমার ছেলে।’

মফিজ উদ্দিনের ছায়া কোচ মিলন

ময়মনসিংহের কলসিন্দুর প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে জাতীয় দলে উঠে এসেছিল একঝাঁক ফুটবলার। সানজিদা খাতুন, মার্জিয়া আক্তার, তহুরা খাতুনদের ফুটবলার হওয়ার নেপথ্য কারিগর ছিলেন কলসিন্দুর স্কুলের সাবেক ক্রীড়াশিক্ষক মফিজ উদ্দিন। পালিচড়া গ্রামের ২৬ বছর বয়সী তরুণ মিলন খানও মফিজ উদ্দিনের মতোই নিঃস্বার্থভাবে বিনা বেতনে মেয়েদের কোচিং করিয়ে চলেছেন। এএফসির ‘বি’ লাইসেন্সধারী এই কোচ হঠাৎ করেই একসময় মেয়েদের কোচিংয়ের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। এর আগে পালিচড়ার মেয়েদের কোচ ছিলেন হারুন অর রশীদ।

এই ফুটবলারদের বল, জার্সি, বুট, সিনগার্ড, হুজসহ অন্যান্য সরঞ্জাম কিনতে টাকার প্রয়োজন। সে টাকা জোগাড় করতে হিমশিম খেতে হয় কোচকে। মাঝেমধ্যে মেয়েদের খ্যাপ খেলিয়ে কিছু টাকা পান। সেই টাকা দিয়ে চলে অনুশীলনের খরচ। আক্ষেপ করে জানালেন, রংপুর জেলা ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন থেকে কোনো অনুদান পান না। এমনকি জেএফএ কাপে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পরও খেলোয়াড়দের কেউ সংবর্ধনা দেয়নি।

তবু স্বপ্ন দেখা

সদ্যপুষ্করিণী উন্নয়ন সংস্থা নামে নারী ফুটবলারদের আর্থসামাজিক উন্নয়নমূলক একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করতে চান কোচ। ফুটবলারদের অভিভাবকদের নিয়ে গড়তে চান সংগঠনটি। এর মাধ্যমেই ভবিষ্যতে চালাতে চান মেয়েদের খেলাধুলার খরচ। শামীমাদের প্রতিভায় মুগ্ধ কোচ স্বপ্ন দেখেন, ‘এই মেয়েদের মধ্যে আছে বিশাল সম্ভাবনা। এই গ্রামের অনেক মেয়েই জাতীয় দলে খেলার যোগ্যতা রাখে। স্বপ্ন দেখি, একদিন বাংলাদেশের জার্সিতে খেলবে পালিচড়ার ১১ কন্যা।’ স্বপ্নটা কি গোপনে পালিচড়ার মেয়েরাও দেখে না!

(প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন রংপুরের নিজস্ব প্রতিবেদক আরিফুল হক)