বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে হত্যা বাড়ছেই

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

সীমান্ত হত্যার সংখ্যা শূন্যতে আনা এবং সীমান্তরক্ষী বাহিনীর প্রাণঘাতী অস্ত্রের ব্যবহার বন্ধের বিষয়ে বাংলাদেশ ও ভারত—দুই দেশই সম্মত হয়েছে কয়েক বছর আগে। এরপরও সেটা বন্ধ হয়নি। বরং বেড়েছে। মানবাধিকার সংস্থাগুলোর হিসাবে চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসেই ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) গুলিতে ১৮ জন নিহত হয়েছেন। আগের বছর এই সংখ্যা ছিল ১৪। 

দেশের বেসরকারি দুই মানবা​ধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) ও অধিকার বলছে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে নিহত হয়েছেন ১৮ জন বাংলাদেশি। এর বাইরে আরও দুজন বিএসএফর নির্যাতনে মারা গেছেন বলে আসকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। এর মধ্যে গত ১০ মে সাতক্ষীরার কুশখালী সীমান্তের কাছে কবিরুল ইসলাম নামের একজনকে পায়ুপথ ও মুখে পেট্রল ঢেলে হত্যা করা হয়েছে; যা পরে বিভিন্ন গণমাধ্যমেও প্রকাশিত হয়।

আসকের তথ্য অনুযায়ী, এই ছয় মাসে সীমান্তে আহত হয়েছেন পাঁচজন এবং অপহরণের শিকার হন ১৯ জন। এর মধ্যে গত ২৭ মে নওগাঁর সাপাহার সীমান্তে আজিম উদ্দিন নামের এক বাংলাদেশি রাখালের দুই হাতের ১০ আঙুলের নখ উঠিয়ে নেওয়া হয়। 

সীমান্ত হত্যা নিয়ে গত জুলাইয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের সঙ্গে এ প্রতিবেদকের কথা হয়। তিনি বলেন, ‘সীমান্ত হত্যা বাড়ার কারণ সীমান্তবর্তী এলাকার কিছু লোকের বেপরোয়া আচরণ। তাঁদের ব্যাপারে বিজিবি (বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ) ও বিএসএফের প্রতিবদেন একই। তাঁদের নিবৃত্ত করার চেষ্টা চলছে।’

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী গত ১১ জুলাই সংসদে বলেছিলেন, ২০০৯ সাল থেকে গত ১০ বছরে বিএসএফের হাতে ২৯৪ জন বাংলাদেশি নিহত হন। সীমান্তে হত্যা বন্ধে বিজিবি সর্বাত্মক প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। পাশাপাশি সরকার কূটনৈতিক পর্যায়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিয়েছে। তিনি সংসদে জানান, ২০১৮ সালে নিহতের সংখ্যা তিনে নেমে এসেছিল।

তবে আসকের হিসাবে ২০১৮ সালে সীমান্তে নিহত বাংলাদেশির সংখ্যা ১৪ জন। আর অধিকারের হিসাবে এই সংখ্যা ১১। এর আগের বছর ২০১৭ সালে নিহতের সংখ্যা আসকের হিসাবে ২৪ এবং অধিকারের হিসাবে ২৫।

ঢাকার পিলখানায় গত ১২-১৫ জুন বিজিবি-বিএসএফ মহাপরিচালক পর্যায়ের বৈঠক হয়। বৈঠক শেষে আয়ো​জিত সংবাদ সম্মেলনে সীমান্ত হত্যা নিয়ে প্রশ্ন করেন সাংবাদিককেরা। জবাবে বিএসএফ মহাপরিচালক রজনীকান্ত মিশ্র বলেছিলেন, সীমান্তে হত্যাকাণ্ড হচ্ছে না, অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু হচ্ছে। তবে তিনি স্বীকার করে নেন যে সীমান্তে প্রাণঘাতী অস্ত্রের ব্যবহার হচ্ছে। এর পেছনে তাঁর যুক্তি ছিল, ভারতীয় সীমান্তের ভেতরে ঢুকে বিএসএফের জওয়ানদের ওপর হামলা চালানোর ঘটনা আছে। প্রাণ বিপন্ন হলেই তারা কেবল গুলি ছুড়ছে।

ওই সংবাদ সম্মেলনে ২০১১ সালে বিএসএফের গুলিতে নিহত ফেলানী খাতুন, ২০১৬ সালের মে মাসে চুয়াডাঙ্গার নতুনপাড়া সীমান্তে কিশোর শিহাব উদ্দিন এবং চলতি বছরের ১০ মে সাতক্ষীরার কুশখালী সীমান্তের কাছে কবিরুল ইসলামকে হত্যার বিষয়েও জানতে চাওয়া হয়। জবাবে ফেলানী হত্যার বিষয়টি আদালতে বিচারাধীন বলে উল্লেখ করলেও অপর দুটি ঘটনা সম্পর্কে তাৎক্ষণিকভাবে কিছু বলতে পারেননি বিএসএফ মহাপরিচালক। 

মানবাধিকারকর্মী ও পর্যবেক্ষকেরা বলছেন, সীমান্তে নাগরিকদের মৃত্যুতে সরকারের পক্ষ থেকে যতটা জোরালো প্রতিবাদ জানানোর রেওয়াজ ছিল, এখন সেটা ততটা জোরালো নয়। অনেকে হয়রানির ভয়ে বিএসএফের নির্যাতনের কথা স্বীকার করছেন না।

পরপর দুটি ঘটনায় স্থানীয় সূত্রগুলো বিএসএফের গুলিতে নিহত হওয়ার কথা বললেও বিজিবি সেটা স্বীকার করেনি। এর মধ্যে গত ১১ জুলাই চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে রয়েল ও পটল নামে দুজন নিহত হন বলে দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবর বের হয়। কিন্তু ওই সীমান্তে মোতায়েন থাকা ৫৩ বিজিবির অধিনায়ক মাহবুবুর রহমান খান প্রথম আলোকে বলেন, এ দুটি ঘটনায় তাঁরা বিএসএফের সম্পৃক্ততার প্রমাণ পাননি। নিহত ব্যক্তিদের পরিবারও কোনো অভিযোগ করেনি। 

গত মঙ্গলবার ভোরে চুয়াডাঙ্গায় দামুড়হুদার ঠাকুরপুর সীমান্তে মো. আবদুল্লাহ নামের এক গরু ব্যবসায়ীকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায়ও বিজিবির পক্ষ থেকে একই রকম বক্তব্য পাওয়া গেছে। 

ফেলানী খাতুন হত্যাসহ সীমান্তে বিভিন্ন হত্যা ও নির্যাতনের ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের আইনি সহযোগিতা দিয়ে আসছে ভারতের বেসরকারি সংগঠন মানবাধিকার সুরক্ষা মঞ্চ (মাসুম)। এ সংগঠনের সম্পাদক কিরীটি রায় প্রথম আলোকে বলেন, ফেলানীসহ আলোচিত সীমান্ত হত্যার একটিরও বিচার হয়নি। ভারতের জাতীয় মানবাধিকার কমিশন ফেলানী খাতুনের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিল। সেটা ভারতীয় কর্তৃপক্ষ মানেনি। তিনি বলেন, দুঃখজনক হলেও সত্য যে নিজ দেশের নাগরিক হত্যা নিয়ে বাংলাদেশের যতটা জোরালোভাবে প্রতিবাদ জানানো উচিত ছিল, ততটা জোরালো নয়।