হাসপাতালগুলো যেন মশার চারণভূমি

ঢাকা মেডিকেলের উন্মুক্ত জায়গায় ডাবের খোসায় জমে আছে পানি, যা মশা বিস্তারে সহায়তা করতে পারে। গতকাল সকালে।  শুভ্র কান্তি দাশ
ঢাকা মেডিকেলের উন্মুক্ত জায়গায় ডাবের খোসায় জমে আছে পানি, যা মশা বিস্তারে সহায়তা করতে পারে। গতকাল সকালে। শুভ্র কান্তি দাশ

মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালটি বছর সাতেক আগে যাত্রা শুরু করেছে। প্রতিষ্ঠানের সব ভবনই নতুন। তবে ভবনের ভেতরে-বাইরে পুরোনো ময়লা-আবর্জনায় ভর্তি। পানি জমে থাকে যেখানে-সেখানে। সরকারের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখা বলেছে, এই প্রতিষ্ঠানে ডেঙ্গুর ভাইরাসবাহী এডিস মশা আছে ঝুঁকিপূর্ণ পর্যায়ে।

গতকাল শুক্রবার সকাল সাড়ে নয়টায় হাসপাতালের মূল ভবনে ঢোকার মুখে চোখে পড়ল মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ শাহ গোলাম নবীর নামে একটি ব্যানার। তাতে লেখা, ‘আপনার বাড়ী-ঘরের অপ্রয়োজনীয় পরিষ্কার পানি ফেলে দিন, ব্যবহার্য পানি ঢেকে রাখুন।’ এডিস মশা ও ডেঙ্গু জ্বরের ব্যাপারে মানুষকে সচেতন করার জন্য অধ্যক্ষ এই বার্তা লিখে রেখেছেন। তবে এলাকাবাসী ও হাসপাতালের কর্মকর্তারা জানালেন, বৃষ্টি হলেই হাসপাতালের সামনের রাস্তায় পানি জমে যায়। ভেতরের চত্বরেও পানি জমে থাকে।

হাসপাতালে দেখা গেল জনা দশেক পরিচ্ছন্নতা-কর্মী বহু দিনের জমে থাকা বর্জ্য অপসারণ করতে হিমশিম খাচ্ছেন। ‘এই ছুটির দিন সকালে হাসপাতাল পরিষ্কার করছেন কেন’—এমন প্রশ্নের উত্তরে একজন নারী পরিচ্ছন্নতাকর্মী বলেন, ‘হাসপাতাল নিয়ে কী জানি হইছে। তাই পুরো হাসপাতাল পরিষ্কার করতে কইছে।’

হাসপাতালের প্রায় প্রতিটি তলায় পানি জমে থাকার মতো জায়গা আছে। দুই দেয়ালের মধ্যে জমে আছে পরিত্যক্ত ওষুধ ও পানির বোতল, পলিথিন, ওষুধের প্যাকেট, ছেঁড়া কাপড়চোপড়, পানিভর্তি বালতি, ডাবের খোসা। 

কোরবানি দেওয়া গরুর মাথার খুলিও দেখা গেছে। চতুর্থ তলায় ভবনের সামনের দিকটা কিছুটা বাড়ানো। সেখানে ফুলের বাগানে পানি জমে আছে। এই তলাতেই হাসপাতালের পরিচালকের কার্যালয়। হাসপাতালে নির্মাণকাজ চলছে, সেখানে জমে আছে পানি, আবর্জনা।

সরকারের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার জরিপে এই হাসপাতালের ভেতরে-বাইরে ৮০ শতাংশ পাত্রে এডিস মশার লার্ভা পাওয়া গেছে। এই হাসপাতালের ভেতরে-বাইরে মশা জন্মানো ও বংশ বিস্তারের উপযুক্ত পরিবেশ রয়েছে। ৩১ জুলাই থেকে ৪ আগস্ট পর্যন্ত রোগনিয়ন্ত্রণ শাখা ঢাকার ১৪টি এলাকায় এই জরিপ করেছিল। এর মধ্যে ১২টি জায়গায় ঝুঁকিপূর্ণ পর্যায়ে লার্ভা পাওয়া গেছে। একটি এলাকায় ২০ শতাংশের বেশি পাত্রে লার্ভা পাওয়া গেলে পরিস্থিতি ঝুঁকিপূর্ণ বলে বিবেচনা করা হয়। ৬০-৮০ শতাংশ পাত্রে এডিসের লার্ভা পাওয়া গেছে এমন তিনটি স্থানের মধ্যে রয়েছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, জরিপের দু-তিন দিন পরই তাঁরা ফলাফল দুই সিটি করপোরেশনকে জানিয়েছিলেন।

গতকাল প্রথম আলোর প্রতিনিধিরা মুগদা হাসপাতালসহ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, মিটফোর্ড হাসপাতাল, শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল, শিশু হাসপাতাল, ঢাকা মহানগর হাসপাতাল এবং ঢাকার বাইরে চট্টগ্রাম, বরিশাল, খুলনা, ময়মনসিংহ, রাজশাহী ও বগুড়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ঘুরে দেখেছেন। এর বাইরে গাজীপুর, মানিকগঞ্জ ও ফরিদপুর জেলার সরকারি হাসপাতালগুলোও ঘুরে দেখেছেন প্রথম আলোর প্রতিনিধিরা। এসব হাসপাতালের প্রায় প্রতিটিতেই পরিবেশ নোংরা, হাসপাতাল চত্বর ও ভেতরে পানি জমে আছে, যেখানে-সেখানে ময়লা-আবর্জনার স্তূপ। দেখলেই বোঝা যায়, অনেক দিন ধরে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা হয় না। 

এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা প্রতিটি হাসপাতালকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার ব্যাপারে নির্দেশ দিয়েছিলাম। এটা তারা পালনও করেছে। তবে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা দৈনন্দিন ব্যাপার। এ ক্ষেত্রে প্রতিদিন নজরদারি করা যায় না। দু-একটি নজরের বাইরে থেকে যাওয়া সম্ভব। তবে আমরা আন্তরিক।’

মুগদা হাসপাতালের ৮, ৯ ও ১০ তলায় ডেঙ্গু রোগী। সরকারি হিসাবে গতকাল ৩৮৫ জন ডেঙ্গু রোগী এই হাসপাতালে ভর্তি ছিল। এ বছর মোট ২ হাজার ১৯৭ জন রোগী এই হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছে। সম্প্রতি এই প্রতিষ্ঠানে আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর উপস্থিতিতে এলাকার সাংসদ সাবের হোসেন চৌধুরী বলেছিলেন, এ বছর হাসপাতালে ভর্তি ডেঙ্গু রোগী ১১ জনের মৃত্যু হয়েছে।

১০ তলায় ওয়ার্ডের বাইরে প্রায় ১০০ রোগী। নার্সরা কাজে খুবই ব্যস্ত। কথা বলার মতো সময় কারও নেই। মতামত নেওয়ার মতো চিকিৎসকও ছিলেন না। মুঠোফোনে চেষ্টা করেও অধ্যক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি। কথা হয় হাসপাতালের পরিচালক আমিন আহমেদ খানের সঙ্গে। তিনি বলেন, হাসপাতালে চিকিৎসকের পদ খালি আছে। ডেঙ্গু রোগী বেড়ে যাওয়ায় চিকিৎসক ও নার্সদের ওপর প্রচণ্ড চাপ পড়েছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কিছু চিকিৎসক দেওয়ার কথা, তবে তাঁরা এখনো কাজে যোগ দেননি।

রোগীরা হাসপাতালের সেবায় সন্তুষ্ট হলেও হাসপাতালের পরিবেশ নিয়ে অভিযোগ করেছেন। একাধিক রোগী বলেছেন, হাসপাতালের প্রায় সব জায়গায় মশা। ১০ তলায় বেশ কিছু রোগীকে মশারি ব্যবহার করতে দেখা যায়। অনেকে মশারি পাননি। অনেকে আবার গরম লাগে বলে মশারি ব্যবহার করেন না।

তবে মশার উৎপাতের কথা স্বীকার করেছেন পরিচালক। তিনি বলেছেন, হাসপাতালটি নিচু এলাকায়। বৃষ্টি হলেই হাসপাতালের সামনের রাস্তায় ও আশপাশে পানি জমে যায়। নির্মাণকাজ চলছে বলে বিভিন্ন তলায় পানি জমে থাকে। তিনি আরও জানান, এ পর্যন্ত এই হাসপাতালের ৩০ জন নার্স ও ১২ জন চিকিৎসক ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন।

কীটতত্ত্ববিদ মঞ্জুর চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘মুগদার মতো হাসপাতালগুলোতে ডেঙ্গুর ভাইরাসবাহী এডিস মশা বেশি। এরা ডেঙ্গুর রোগীর রক্ত খাচ্ছে, আর অন্যদের শরীরে তা ছড়াচ্ছে। চিকিৎসক ও নার্সরা আক্রান্ত হওয়া তার জ্বলন্ত প্রমাণ।’