শূন্য থেকে সেরা চা-বাগান

পাম্পের সাহায্যে হালদা ভ্যালি চা–বাগানে সেচ পদ্ধতিতে চা উৎপাদন করা হয়। সম্প্রতি চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির নারায়ণহাট এলাকায়।  ছবি: সৌরভ দাশ
পাম্পের সাহায্যে হালদা ভ্যালি চা–বাগানে সেচ পদ্ধতিতে চা উৎপাদন করা হয়। সম্প্রতি চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির নারায়ণহাট এলাকায়। ছবি: সৌরভ দাশ

এক যুগ আগেও ছিল ঝোপঝাড়। পাহাড়ি এলাকায় এমন ঝোপঝাড়ে ভয়ে পথ মাড়াত না কেউ। নামে চা-বাগান হলেও চা-গাছ ছিল হাতে গোনা। এক উদ্যোক্তা বাগানটি নিলামে নিলেও সফল হতে পারেননি। আট বছর চেষ্টা করে শেষ পর্যন্ত পিছু হটেছিলেন তিনি। উৎপাদন নেমে এসেছিল শূন্য কেজিতে। সেই বাগানেই এখন সারি সারি চা-গাছ। শ্রমিকদের তুমুল ব্যস্ততা।

চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির শেষ প্রান্তে নারায়ণহাট ইউনিয়নে এ বাগানের নাম হালদা ভ্যালি। চায়ের ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে যাওয়া শতবর্ষী এই বাগানের সাফল্যের কথা এখন নতুন করে লেখা হচ্ছে। গত বছর সব বাগানকে পেছনে ফেলে চা উৎপাদনে ‘সেরা পুরস্কার’ পেয়েছে বাগানটি। ২০১৭ সালের উৎপাদনের ভিত্তিতে চা বোর্ড এই পুরস্কার দেয়।

পরিত্যক্ত বাগানকে উৎপাদনে সেরা করে তোলার নেপথ্যে আছে এক উদ্যোক্তার কিছু পদক্ষেপ। তিনি হলেন পানির পাম্প বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠান পেডরোলো এনকে লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাদের খান। বাগানটি ১৯০৫ থেকে ২০০২ সাল পর্যন্ত ছয়টি সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের হাত ঘুরে সব শেষে আসে পেডরোলো গ্রুপের হাতে।

এখানকার মাটি চা চাষের উপযোগী করা থেকে শুরু করে ফলন তোলা পর্যন্ত প্রতি ধাপেই নতুন কৌশল ব্যবহার হয়েছে বাগানটিতে। তাতেই উৎপাদনে এমন সাফল্য। এই চা-বাগানের নতুন কৌশল এখন ব্যবহার করতে শুরু করেছেন অন্যরাও।

চা উৎপাদনের এই সাফল্য দেখতে যাই চট্টগ্রাম শহর থেকে ৬১ কিলোমিটার দূরে ফটিকছড়িতে। শহরের প্রবর্তক মোড় থেকে দুই ঘণ্টা লাগে সেখানে পৌঁছাতে। দুপুরে পৌঁছানোর পর চা-বাগানের জ্যেষ্ঠ ব্যবস্থাপক জাহাঙ্গীর আলম দেরি না করে ছোট্ট গাড়ি নিয়ে রওনা হলেন বাগানের দিকে।

>ফটিকছড়ির হালদা ভ্যালি চা-বাগান ছিল পরিত্যক্ত
এখন উৎপাদনে সেরা


চা-বাগানের মাঝ দিয়ে গাড়ি চলাচলের উপযোগী কাঁচা রাস্তা আঁকাবাঁকা পথ ধরে এগিয়ে গেছে। সবুজ পাতা তুলে ঝুড়িতে রাখছেন শ্রমিকেরা, চলছে পরিচর্যার কাজও। বাগানের ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর জানালেন, ২০০৩ সালে একজন শ্রমিক দিয়ে শুরু হয় কাজ। এখন ১ হাজার ৫২ একর বাগানের ৯৩০ একর চা চাষের আওতায় আনা হয়েছে। 

শুরুর কথা

২০০৩ সালে এক বন্ধুর পরামর্শে হালদা ভ্যালি ইজারা নেন নাদের খান। তখন এখানে চা-গাছ ছিল না। ছিল কেবল ঝোপঝাড়। প্রথমে ঝোপঝাড় পরিষ্কার করে শুরু হলো কাজ। নাদের খান নিজে দাঁড়িয়ে থেকে দেখলেন, গাছের শিকড় মাটির গভীরে চলে গেছে। চাষের উপযোগী করতে নিজের সিদ্ধান্তে এক্সকাভেটর ব্যবহার করে সব শিকড় উপড়ে ফেলা হলো। প্রথম বছর চা চাষের উপযোগী করে তোলা হয় ১২ একর জায়গা। তাতে রোপণ করা হয় সাড়ে ৭২ হাজার চারা গাছ।

তবে পানির অভাবে এক বছরের মাথায় মারা গেল অর্ধেক চা-গাছ। গাছ বাঁচাতে হাসপাতালে ব্যবহৃত স্যালাইনের প্যাকেটে পানি ভরে প্রতিটি গাছের সঙ্গে যুক্ত করে দেওয়া হয়। কিন্তু এ পদ্ধতি সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। থাইল্যান্ডে একটি ফলের বাগানে সেচব্যবস্থা দেখে এসে ২০০৭ সালে হালদা ভ্যালিতে চালু করেন স্থায়ী সেচব্যবস্থা।

বাগানের মাঝামাঝি এসে দেখা গেল, চা-গাছের ওপর বৃষ্টির মতো পানি পড়ছে। সেচ নলের মাথায় ঘূর্ণমান নজেল প্রায় ১২০ ফুট এলাকায় অবিরত বর্ষণ করে যাচ্ছে। বাগানের ব্যবস্থাপক জানালেন, এটিই স্থায়ী সেচ পদ্ধতি। পাম্পের সাহায্যে পুরো বাগানে একসঙ্গে সেচ দেওয়া যায়। পুরো বাগান এখন এই সেচের আওতায়।

সেচের পাশাপাশি রাসায়নিক সারের পরিবর্তে কেঁচো সারের ব্যবহারও শুরু হয়েছে হালদা ভ্যালিতে। বছরে ৪০০ টন কেঁচো সার তৈরির প্রকল্প নিয়েছে বাগান কর্তৃপক্ষ।

সাফল্য

শুষ্ক মৌসুমে প্রতিটি চা-বাগানে পানির অভাবে হাহাকার পড়ে যায়। তবে অনাবৃষ্টিতে দুশ্চিন্তা নেই হালদা ভ্যালির। প্রয়োজনমতো পানি পেয়ে ফলন বাড়তে থাকে বাগানটিতে। ২০১৭ সালে চা-বাগানে হেক্টরপ্রতি সর্বোচ্চ উৎপাদন করে প্রথমবার নজর কাড়ে বাগানটি। সেবার দেশে হেক্টরপ্রতি গড় উৎপাদন ছিল ১ হাজার ৪৭৭ কেজি। হালদা ভ্যালিতে ছিল ৩ হাজার ৭১৭ কেজি। গত বছর হেক্টরপ্রতি গড় উৎপাদন যেখানে ছিল ১ হাজার ৫২৯ কেজি, সেখানে হালদা করেছে ৩ হাজার ৮০১ কেজি। আর গত বছর মোট উৎপাদন ছিল প্রায় ৯ লাখ কেজি।

চা বোর্ডের উপপরিচালক (পরিকল্পনা) মুনির আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, চা উৎপাদনে সরকার যে নীতি নিয়েছে, তার সুফল হলো হালদা ভ্যালির মতো পরিত্যক্ত বাগান উৎপাদনে যুক্ত হওয়া। বাগানটি প্রথমবারের মতো এক্সকাভেটর ব্যবহার করে পতিত জমি চা চাষের আওতায় এনেছে। প্রথমবার চা-বাগানে স্থায়ী সেচব্যবস্থা চালু করে পানির সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করেছে। এসব এখন অন্য বাগানও অনুসরণ করছে।

হালদার এ সাফল্যের কথা এখন অন্য বাগানমালিকদের জানা। এর মধ্যে ফিনলে, ব্র্যাকসহ সাতটি বাগানে স্থায়ী সেচব্যবস্থা চালু হয়েছে। জানতে চাইলে কর্ণফুলী বাগানের ব্যবস্থাপক শফিকুল ইসলাম জানান, ২০১০ সাল থেকে হালদার মতো স্থায়ী সেচব্যবস্থা চালুর পর তাঁদের বাগানে ফলন বাড়ছে। 

হরেক রকম চা

ব্ল্যাক টি বা সাধারণ চায়ের পাশাপাশি এখন সাদা চায়ের মতো দামি চা উৎপাদন করতে শুরু করেছে এই বাগান। চা গাছের শুধু ছোট কুঁড়ি থেকে তৈরি হচ্ছে এই সাদা চা। ‘সিলডার নিডল হোয়াইট টি’ নামে তা বাজারজাতও করছে হালদা ভ্যালি। আবার চীনের গ্রিন টির স্বাদ যাতে পাওয়া যায়, সে জন্য বিশেষায়িত গ্রিন টিও তৈরি করা হচ্ছে এখানে। চায়না বুশ-১ ও ২ জাতের চারা থেকে তৈরি হচ্ছে ড্রাগন ওয়েল গ্রিন টি। চীন থেকে ‘টি মাস্টার’ প্রতিবছর চায়ের গুণগত মান ঠিক আছে কি না দেখে যাচ্ছেন। এসব দামি চা বাজারজাত হচ্ছে ৮ হাজার থেকে ১১ হাজার টাকা কেজিতে।

রপ্তানি

প্রতিটি চা-বাগানের মতো হালদা ভ্যালিতে উৎপাদিত চা পাঠানো হয় নিলামে। আবার বাগানমালিকেরা কর পরিশোধ করে নির্দিষ্ট পরিমাণ চা বাজারজাত করতে পারেন। চায়ের দেশ চীনে প্রথমবারের মতো গ্রিন টি রপ্তানি করেছিল হালদা ভ্যালি। এবার কুয়েত থেকে পাওয়া গেছে নতুন রপ্তানি আদেশ।

পেডরোলো গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাদের খান বলেন, ‘চা গাছ কী চায় সেটি দিতে পারলে উৎপাদনে সাফল্য আসবেই। এই চা-বাগানকে আদর্শ বাগান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চাই। বাগানের প্রাকৃতিক ভারসাম্য ঠিক রাখতে যেকোনো প্রাণী শিকার নিষিদ্ধ করা হয়েছে। প্রাকৃতিক বনও রাখা হয়েছে। অনেক বাগান হালদা ভ্যালিকে অনুসরণ করছে, এটিও বড় পাওয়া।’