একজন রফিকুল ও অসহায় শিশুরা

আগুনে পুড়ে নিজের সব সম্বল শেষ। আগুন নেভাতে গিয়ে ডান পা ভেঙেছে। মেরুদণ্ডের তিনটি হাড়েও ধরেছে চিড়। পরিবারের ছয় সদস্য নিয়ে মানবেতর দিন পার করছেন রূপনগরের ঝিলপাড় বস্তির বাসিন্দা রিকশামিস্ত্রি রফিকুল ইসলাম।  ছবি: প্রথম আলো
আগুনে পুড়ে নিজের সব সম্বল শেষ। আগুন নেভাতে গিয়ে ডান পা ভেঙেছে। মেরুদণ্ডের তিনটি হাড়েও ধরেছে চিড়। পরিবারের ছয় সদস্য নিয়ে মানবেতর দিন পার করছেন রূপনগরের ঝিলপাড় বস্তির বাসিন্দা রিকশামিস্ত্রি রফিকুল ইসলাম। ছবি: প্রথম আলো

নিজের ঘর মুহূর্তে পুড়ে ছাই। হা–হুতাশ করে কী লাভ! বরং প্রতিবেশীর ঘরটা যাতে রক্ষা পায় মরিয়া হয়ে সেই চেষ্টাই করছিলেন বছর চল্লিশের রফিকুল ইসলাম। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের সঙ্গে পানির পাইপ নিয়ে উঠেছিলেন একটি দ্বিতল ভবনে। আগুনের লেলিহান শিখাকে বাগে আনতে ভবনের কিনার ঘেঁষে পানি ছুড়ছিলেন। হঠাৎ পা ফসকে ভবনের নিচে পড়ে যান তিনি। এতে তাঁর ডান পা ভেঙে গেছে। মেরুদণ্ডের তিনটি হাড়েও ধরেছে চিড়।

গত শুক্রবার সন্ধ্যায় রূপনগরের ঝিলপাড় বস্তিতে লাগা আগুন নেভাতে গিয়ে এই দশা রফিকুল ইসলামের। পরিবারের ছয় সদস্যকে নিয়ে তিনি আশ্রয় নিয়েছেন ঝিলপাড় বস্তিসংলগ্ন বঙ্গবন্ধু বিদ্যানিকেতনে।

গতকাল মঙ্গলবার দেখা যায়, বিদ্যালয়টির বারান্দায় তিনটি বেঞ্চ পেতে থাকছে পরিবারটি। পেশায় রিকশামিস্ত্রি রফিকুল বলেন, ‘নিজের তো সব গ্যাছে। অন্যেরটা যাতে রক্ষা পায় ওইটাই খালি মাথায় ঘুরছিল।’ পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তির এমন অবস্থায় চোখে অন্ধকার দেখছেন রফিকুলের স্ত্রী আয়েশা বেগম। তিনি বলেন, ‘ডাক্তার কইছে ছয় মাস বিছানায় পইড়া থাকতে হইবে। ঘটি–বাটি যা ছিল সব তো গেছে। চিকিৎসা কী করে করুম। তিন মাইয়া ও দুই পোলা লইয়া আন্ধার দেখতাছি।’

রফিকুলের পরিবারের সদস্যদের মতো অসহায় দিন কাটছে বস্তিতে অগ্নিকাণ্ডে ঘরহারা পরিবারগুলোর শিশু সদস্যদেরও। বস্তির বাসিন্দারা বলছেন, প্রতিদিন তিন বেলা বড়দের খাবার জুটলেও শিশুখাদ্যের অভাবে মানবেতর দিন পার করছে শিশুরা। প্রচণ্ড গরমে গাদাগাদি করে থাকা পরিবারের নারী–শিশুরা জ্বর–সর্দি–কাশিতে ভুগছে।

বঙ্গবন্ধু বিদ্যানিকেতনের নিচতলার একটি ছোট কক্ষে ৩৪টি পরিবার আশ্রয় নিয়েছে। নারী ও শিশুরা রাতে কোনোরকমে ঘুমাতে পারলেও পুরুষেরা পাঁচ দিন ধরে নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছেন। কক্ষটিতে আশ্রয় নেওয়া হিরু, মিলন শফিকুলরা জানান, প্রচণ্ড গরমে নারী ও শিশুরা অসুস্থ হয়ে পড়ছে। টাকাপয়সা না থাকায় শিশুখাদ্য কেনার সামর্থ্য নেই তাঁদের। এখন পর্যন্ত কোনো ধরনের শিশুখাদ্যের সহযোগিতা পাননি তাঁরা।

পোড়া ভিটামাটিতেই রাত কাটাচ্ছে অনেক পরিবার। সালাউদ্দিন-আয়েশা ও মোর্শেদা-রুবেল দম্পতি চার দিন ধরে খোলা আকাশের নিচে। দিনের বেলা প্রচণ্ড গরম ও রাতে মশার কামড়ে তাদের ওই দুই পরিবারের শিশু হাবিবা ও রহমান অসুস্থ হয়ে পড়েছে।

শক্তি ফাউন্ডেশন নামের একটি বেসরকারি সংস্থা বিনা মূল্যে চিকিৎসা ও ওষুধ দিয়েছে। সংস্থাটির ব্যবস্থাপক ফাতেমা চৌধুরী জানান, সোমবার ৪৩০ জন ও বুধবার ৭১৫ জন বস্তিবাসীকে তাঁরা বিনা মূল্যে চিকিৎসাসেবা ও ওষুধ দিয়েছেন। সীমিত সামর্থ্যের কারণে চিকিৎসাসেবা কার্যক্রম আর চালানো সম্ভব নয় বলে জানান তিনি।

অগ্নিকাণ্ডের পর বস্তির শিশুদের পড়াশোনাও অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। সুরভি নামের একটি বেসরকারি সংস্থা ইউনিসেফের সহযোগিতায় ঝিলপাড় বস্তিতে পাঁচটি স্কুল পরিচালনা করত। শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল দেড় শ। সংস্থাটির দুই কর্মী শারমিন ও আল ইমরান পোড়া বস্তি ঘুরে শিক্ষার্থীদের খুঁজছিলেন। তাঁরা বলেন, পাঁচটি স্কুলের মধ্যে দুটি পুড়ে গেছে। অনেক শিক্ষার্থীকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। অনেকেই এবার প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা দেবে। ওই শিশুরা আবার শিক্ষার সুযোগ পাবে কি না, ঠিক জানেন না তাঁরা।