আল-কায়েদাপন্থী জঙ্গি সংগঠন এখন ঝুঁকির কারণ

আল–কায়েদাপন্থী জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলাম বাংলাদেশের জন্য বড় ঝুঁকির কারণ হতে পারে। নিষিদ্ধঘোষিত এই জঙ্গি সংগঠনটির তৎপরতা কৌশলগত কারণে দৃশ্যমান নয়। জনগণকে সম্পৃক্ত করে তারা ‘জিহাদে’ নামতে চায়। আর এ কাজে তারা ব্যবহার করছে মূলত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো।

পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি)–এর প্রধান মনিরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, সংগঠনটির অনলাইন ফোরামে সক্রিয় আছে প্রায় তিন শ সদস্য। তারা ধীরে কিন্তু ধারাবাহিকভাবে এগোচ্ছে। অনলাইনে বহুল প্রচলিত, জনপ্রিয় ও বিতর্কিত ইস্যুর আলোচনা উসকে দিয়ে তারা নিজেদের মতবাদ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে যাচ্ছে। তাদের উদ্দেশ্য জনগণের বড় একটা অংশকে নিজস্ব মতাদর্শে উদ্বুদ্ধ করা। উগ্র মানুষগুলোকে পাশে নিয়ে তারা ‘জিহাদ’ করতে চায়। কর্মী সংগ্রহের চেয়ে সমর্থক সংগ্রহে তাদের আগ্রহ বেশি।

আল–কায়েদা যে ক্রমাগত বাংলাদেশ ও আশপাশের দেশগুলোর জন্য ঝুঁকি হয়ে উঠছে, সে সম্পর্কে গত সোমবার এক সাক্ষাৎকারে মার্কিন কর্মকর্তা জন টি গডফ্রে সাংবাদিকদের বলেন, সিরিয়া ও ইরাকে ইসলামিক স্টেট বা আইএস মোকাবিলায় সবাই ব্যস্ত ছিল। এই ফাঁকে বিশ্বের সবচেয়ে সুযোগসন্ধানী জঙ্গি সংগঠন আল–কায়েদা নিজেদের নেটওয়ার্ক জোরদার, সক্ষমতা বৃদ্ধি ও দল গোছানোর কাজ করে গেছে। সামনের দিনগুলোয় আল–কায়েদা ইন ইন্ডিয়ান সাবকন্টিনেন্ট বা একিউআইএস বাংলাদেশকে ঝুঁকিতে ফেলতে পারে। ভৌগোলিক কারণে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক জঙ্গিগোষ্ঠীগুলোর বিশেষ নজরে আছে। 

 সিটিটিসি সূত্রগুলো বলছে, আনসার আল ইসলাম সমাজে যুগ যুগ ধরে চলে আসা জীবন ও সংস্কৃতির বিরুদ্ধে মানুষকে ধীরে ধীরে অসহনশীল করে তোলার কৌশল হাতে নিয়েছে। নববর্ষ উদ্‌যাপন, শবে বরাত পালন, মিলাদ বা মৃত্যুর পর প্রচলিত কিছু আচার–অনুষ্ঠান নিয়ে অনলাইন ফোরামে প্রশ্ন তুলছে তারা, নিজেদের যুক্তি দিচ্ছে ও জনমত সৃষ্টির চেষ্টা করছে। সাম্রাজ্যবাদী শক্তি এবং পবিত্র কোরআন ও হাদিস সম্পর্কে নিজেদের ভাষ্যও এসব আলোচনায় যুক্ত করছে। এতে বুঝে না–বুঝে অনেকে অংশ নিচ্ছে। অনেকে তাদের প্রচারিত মতবাদকে সত্য বলে ধরে নিচ্ছে। 

২০০৯–১০ সালের দিকেই মূলত আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের ব্যানারে বেশ কিছু তরুণ ব্লগে লেখালেখি করত। তাদের উদ্দেশ্য ছিল আল–কায়েদার শীর্ষ নেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা। তবে ২০১৩ সালে ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দার খুনের আগে তাদের তৎপরতা সম্পর্কে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ছিল অন্ধকারে। ২০১৪ সালে আল–কায়েদা বাংলাদেশ, ভারত ও মিয়ানমারে তাদের উপস্থিতির কথা ঘোষণা করে। আল–কায়েদা ইন্ডিয়ান সাবকন্টিনেন্টের অংশ হিসেবে তখন থেকে কাজ শুরু করে আনসার আল ইসলাম। ওই বছরই দুটি হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করে বিবৃতি দেয় সংগঠনটি।

সরকারি সূত্রগুলো বলছে, বাংলাদেশে নিষিদ্ধঘোষিত জঙ্গি সংগঠনের সংখ্যা ৭। এগুলো হলো হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামী বাংলাদেশ (হুজি–বি), জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি) ও আইএসপন্থী জঙ্গি সংগঠন নব্য জেএমবি, জাগ্রত মুসলিম জনতা বাংলাদেশ বা জেএমজেবি, শাহাদৎ–ই–আল হিকমা, হিযবুত তাহ্‌রীর ও আনসার আল ইসলাম। 

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সূত্রগুলো বলছে, এই সংগঠনগুলোর মধ্যে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর সঙ্গে সম্পৃক্ততা আছে এমন তিনটি সংগঠনের কার্যক্রম চলছে। এগুলো হলো জেমবির নতুন ও পুরোনো অংশ, আনসার আল ইসলাম ও হিযবুত তাহ্‌রীর। এ মুহূর্তে সবচেয়ে ভালো অবস্থানে আছে আনসার আল ইসলাম। যদিও ২০১৬ সালের ২৪ মে কলাবাগানে জুলহাস মান্নান ও তানভীর তনয়কে কুপিয়ে হত্যার পর মাঠে তাদের আর কার্যক্রম ছিল না। মূলত গুলশানের হোলি আর্টিজান বেকারিতে আইএস–সমর্থিত জঙ্গি সংগঠন নব্য জেএমবি হামলা চালানোর পর মাঠ থেকে সরে আসে আনসার আল ইসলাম। কেন সরে এল তার একটা ব্যাখ্যা পাওয়া যায়, সংগঠনটির নিজস্ব নথি থেকে।

নথিতে আনসার আল ইসলাম কীভাবে এগোবে সেই আলোচনা করেছে। তারা বলেছে, ক্ষমতা তৈরির আগে নিজের কর্মকাণ্ডের পরিধি এমনভাবে বাড়াবে না, যা তাদের পতন ডেকে আনতে পারে। গোপনে তারা নিজেদের প্রসার ঘটাবে। তাদের বৃদ্ধি, বিভিন্ন দলের সঙ্গে সম্পৃক্ততাও গোপন রাখবে এবং নির্দিষ্ট সময়ের আগে গণমাধ্যমে প্রচারে যাবে না। বোঝাতে হবে তারা কোথাও নেই। 

ওই নথিতে আরও বলা হয়েছে, রমনার বটমূল, নিউ ইয়ার বা ভ্যালেন্টাইন ডের অনুষ্ঠানে চাঞ্চল্যকর হামলা করা তুলনামূলকভাবে সহজ কিন্তু কৌশলগতভাবে এর কোনো তাৎপর্য নেই। শিয়া, আহমদিয়া, মিশনারি ও এনজিওদের ওপর হামলা চালিয়ে লাভ হবে না। সাধারণ জনগণ এ ধরনের হামলা প্রাথমিক অবস্থায় পছন্দ করবে না। তারা মনে করে, বাংলাদেশ সরকার এখন জনসমর্থনহীন, ভারত–সমর্থিত এবং ইসলামবিরোধী হিসেবে একটা প্রচার আছে। জনগণকে উদ্বুদ্ধ করার ক্ষেত্রে এটাকে তারা কাজে লাগাবে।

কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমের কর্মকর্তারা প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা বিভিন্ন অভিযান থেকে কয়েক হাজার পৃষ্ঠার নথি উদ্ধার করেছেন। ওই নথিতে হত্যা ও হামলার লক্ষ্যস্থল চিহ্নিত করা আছে।

দুর্বল হয়েও টিকে আছে জেএমবি ও হিযবুত তাহ্‌রীর

সিটিটিসি বলছে, আইএসপন্থী জঙ্গি সংগঠন জেএমবি নেতৃত্ব ও অর্থসংকটে আছে। ১৯৯৮ সালে শায়খ আবদুর রহমান আহলে হাদীস অনুসারী ও আহলে হাদীস বাংলাদেশ–এর জঙ্গি সদস্যদের নিয়ে কাজ শুরু করেছিলেন সবুজবাগের একটি বাসায়। ২০০২ সালের ২০ মে দিনাজপুরের পার্বতীপুর ২৫টি পেট্রলবোমা ও সংগঠনের কাগজপত্রসহ আটজন কর্মী গ্রেপ্তার ও একই বছর জয়পুরহাটের ক্ষেতলালে পুলিশের টহল দলের বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধের মধ্য দিয়ে সংগঠনটি আত্মপ্রকাশ করে। ২০০৫ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি নিষিদ্ধ হওয়ার কয়েক মাসের মাথায় ১৭ আগস্ট দেশব্যাপী বোমা হামলা চালায় তারা।

পুলিশ সদর দপ্তরের নথিতে দেখা যাচ্ছে, ২০০৫ সালে তাদের ১ হাজার ৫০০ সক্রিয় সদস্য ছিল। পুরোনো জেএমবির আমির সালাউদ্দীন সালেহীন এখন ভারতে। কারাগারের ভেতরে সংগঠনটির আমির সাইদুর রহমান। আইএসের সঙ্গে দলটির একাংশ হাত মিলিয়ে হোলি আর্টিজান বেকারির মতো বড় হামলা চালিয়েছে। এরপর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ধারাবাহিক অভিযানে তাদের নেটওয়ার্ক অনেকটাই বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে। গ্রেপ্তার হন প্রায় সাড়ে তিন শ কর্মী–সমর্থক।

সিটিটিসির প্রধান মনিরুল ইসলাম বলেন, সম্প্রতি ঢাকায় পুলিশের ওপর পরপর যে দুটি বোমা হামলা হলো, বোমাগুলো ছিল খুবই দুর্বল। তবে দলটির কর্মী–সমর্থক রয়েছে।

অন্যদিকে হিযবুত তাহ্‌রীর আপাতত তাদের তৎপরতা অনলাইনে, পোস্টার ও লিফলেট বিলিতে সীমাবদ্ধ রেখেছে।

নিরাপত্তা বিশ্লেষক শাহাব এনাম খান প্রথম আলোকে বলেন, আইএস বা আল–কায়েদা ছাড়াও সামগ্রিকভাবে জঙ্গিবাদের বিস্তার নিয়ে সতর্ক থাকা প্রয়োজন। বাংলাদেশের জন্য জঙ্গিবাদ নিঃসন্দেহে একটি গুরুত্বপূর্ণ নিরাপত্তা সমস্যা। দেশের অভ্যন্তরীণ জঙ্গিগোষ্ঠীগুলোর গতি–প্রকৃতি, আদর্শিক ভিত্তি, কার্যপরিধি কিংবা কার্যক্রম বাস্তবায়ন করার ক্ষমতা সরলভাবে দেখার সুযোগ নেই।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষকের আশঙ্কা, এ দুটি উগ্রবাদী গোষ্ঠীর বাইরে বিভিন্ন ব্যক্তি এবং গোষ্ঠী বিভিন্ন ধরনের আদর্শিক বা দলীয় নামে জঙ্গিবাদী কার্যক্রম চালাতে পারে। কারণ, আইএস এবং আল–কায়েদার সঙ্গে অভ্যন্তরীণ উগ্রবাদী জঙ্গিগোষ্ঠীগুলোর সম্পৃক্ততার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে।