শহুরে হাওয়ায় শিউলির সৌরভ

এই ঠাসবুনটের শহরে ‘বর্ষার গর্ভ থেকে জন্ম নেওয়া’ শুভ্র শরতের উদ্ভাসিত রূপ বোঝা কঠিনই বটে। তবে নীলচে আকাশের বুক চিরে ভেসে 

ওঠা তুলার মতো সাদা মেঘ আর নগরকাননে ফোটা স্নিগ্ধ শিউলি দেখে এর অস্তিত্বের আঁচ পাওয়া সম্ভব। 

শরৎ মানেই শিউলি ফোটার মৌসুম। ভোরের বাতাসে ভেসে আসে তার মধুগন্ধ। ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের কালীমন্দির–সংলগ্ন জায়গা, শিশু একাডেমি প্রাঙ্গণ, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, বলধা গার্ডেন কিংবা জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানে শিউলিগাছের দেখা মিলবে। আদর-যত্নে গ্রামের মতো শহরের বাড়ির আশপাশে কিংবা উঠানের কোণেও অনেকে শিউলিগাছ বড় করেন। ইদানীং ছাদের টবে এই গাছ লাগানোর চর্চাও শুরু হয়েছে। তবে নিয়মমতো প্রচুর পানি দেওয়ার দরকার হয়।

শিউলির বরফসাদা পাপড়িগুলো পরস্পরের সঙ্গে জোড়া লাগানো। নিচে কমলা রঙের বৃন্ত। শিউলি ফুলের কলিরা মুখ তোলে সন্ধ্যায়। বেলা ডোবার পর থেকে ফুটতে থাকে। বাতাসে ভেসে আসা মিষ্টি সুবাস জানিয়ে দেয় তার অস্তিত্ব। শিউলি ফুলের আয়ু বড়ই স্বল্প। ঝরে পড়ে সূর্যোদয়ের আগেই। গাছতলা ভরে ওঠে সাদা ফুলের স্নিগ্ধ সমারোহে। বাড়ির আশপাশে শিউলিগাছ থাকলে ভোরে ঘুম থেকে উঠে ছেলেপুলেদের তার তলায় ফুল কুড়াতে যাওয়ার উৎসাহ-আনন্দ চিরকালের। সেই স্মৃতি হয়তো অনেকেই ফিরিয়ে নিয়ে যায় শিউলি-সুরভিত শৈশবের দিনগুলোতে। 

এই ইট-কাঠের রাজধানীতে শিউলি কুড়ানোর সেই দিন ফিরে পাওয়া হয়তো সম্ভব নয়। তবে শাহবাগ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, ধানমন্ডি ২৭ নম্বরের মোড় কিংবা সংসদ ভবনের ক্রিসেন্ট লেক–সংলগ্ন এলাকায় শিউলি ফুলের মালা কিনতে পাওয়া যাবে ভ্রাম্যমাণ ফুল বিক্রেতাদের কাছ থেকে। এর মধ্যে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হলের ক্যানটিনের সামনে লাগানো শিউলিগাছটি ফুল ফোটানো শুরু করেছে। সকালবেলায় আশপাশের এলাকার হিন্দুধর্মাবলম্বী নারীরা ঝরা ফুল কুড়িয়ে নিয়ে যান পূজার জন্য। বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের কাছেও পবিত্র পুষ্প হিসেবে শিউলির আলাদা মর্যাদা আছে।

শিউলি নিয়ে পুরাণের বিষণ্ন কাহিনিটি জানা যাবে নিসর্গবিদ দ্বিজেন শর্মার শ্যামলী নিসর্গ বই থেকে। লোকমুখেও এই গল্পের প্রচার আছে। গল্পে বলা হচ্ছে, কোনো এক কালে এক রাজকন্যা ভালোবেসেছিলেন সূর্যকে। ব্যর্থ হলো তাঁর প্রেম। প্রবঞ্চিত রাজকন্যা হলেন আত্মঘাতী। তাঁর চিতাভস্ম থেকে জন্মাল একটি গাছ। আর সেই গাছেই তাঁর বেদনা ফুটল শুভ্র ফুল হয়ে। রাতের নিভৃতে। সূর্যের আলোর স্পর্শ পাওয়ার আগেই সেই ফুল ঝরে গেল।

শিউলি এই উপমহাদেশেরই নিজস্ব উদ্ভিদ। আদি নিবাস মধ্য ও উত্তর ভারতে। বৈজ্ঞানিক নাম Nyctanthes arbortristis। তেমন বড় নয়। ডালপালা প্রচুর। বাকল পুরু, ফ্যাকাশে রঙের। সরু শাখার দুই পাশে বিপরীত দিকে ঘন পাতার বিন্যাস। পাতা একটু খসখসে। কিনার খাঁজকাটা ও ডগা সরু। শীতে ও বসন্তে পাতা ঝরে যায়। গ্রীষ্মে নতুন পাতায় শাখা ভরে ওঠে। ফুল ফোটা শুরু হয় শরতের প্রথম থেকে। তবে হেমন্তও এই ফুল ফোটে, ঝরে। কার্তিকের প্রথম দিকে ফুল কিছুটা কম হয়, তবে মাসের শেষ দিকে ফুলের সংখ্যা বাড়ে। শিউলির অন্য নাম শেফালি। এই দুটো নাম বারবার এসেছে রবীন্দ্রনাথের গান ও কবিতায়। 

শিউলির ভেষজ গুণও অনন্য। স্বাদে তিতা হলেও মৌসুমি জ্বর, গলা বসা, ক্রিমি, জন্ডিস ও খাদ্যে বিষক্রিয়াজনিত সমস্যায় দু-তিন চামচ পাতার রস সেবন উপকারী। এ ছাড়া অতীতে খাবারের রং হিসেবে শিউলি বোঁটার ব্যবহার ছিল। শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যানতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক আ ফ ম জামাল উদ্দীন বলেন, ‘পাশের দেশ ভারতে শিউলি বোঁটা থেকে উৎকৃষ্ট মানের প্রাকৃতিক রং তৈরি করা হয়। চাইলে আমাদের দেশেও এটা করা সম্ভব।’