চাঁদাবাজি বন্ধের কথাই নেই

মহাসড়কে দূরপাল্লার যানবাহনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলছে তিন চাকার যান। অথচ এসব তিন চাকার যান মহাসড়কে নিষিদ্ধ। বগুড়া-রংপুর মহাসড়কের নওদাপাড়া এলাকা।  ফাইল ছবি
মহাসড়কে দূরপাল্লার যানবাহনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলছে তিন চাকার যান। অথচ এসব তিন চাকার যান মহাসড়কে নিষিদ্ধ। বগুড়া-রংপুর মহাসড়কের নওদাপাড়া এলাকা। ফাইল ছবি

সড়কে বিশৃঙ্খলার পেছনে পরিবহন খাতে চাঁদাবাজি বড় কারণ। কিন্তু এ খাতে কীভাবে চাঁদাবাজি হয় এবং তা বন্ধের বিষয়টি স্থান পায়নি সাবেক নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খানের নেতৃত্বাধীন কমিটির সুপারিশে। এমনকি দুর্ঘটনায় প্রাণহানির শাস্তি কিংবা ঝুলে থাকা সড়ক পরিবহন আইনের বাস্তবায়ন নিয়েও কোনো সুপারিশ নেই। সড়ক মন্ত্রণালয়ে দেওয়া ১১১ দফা সুপারিশের প্রায় সব কটিই পুরোনো। এগুলো মোটরযান আইনেও আছে। কিন্তু তা বাস্তবায়নে সরকারের মনোযোগ না থাকায় সুপারিশের স্তূপ জমছে।

সড়কে শৃঙ্খলা আনা এবং সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে গত ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিলের সভায় শাজাহান খানের নেতৃত্বে ২২ সদস্যের কমিটি করা হয়। গত বৃহস্পতিবার কমিটি চূড়ান্ত সুপারিশের কপি সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিলের সভাপতি সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের হাতে তুলে দেয়। এ সময় সড়কমন্ত্রী জানিয়েছেন, সুপারিশ বাস্তবায়নে টাস্কফোর্স গঠন করা হবে।

অবশ্য এর আগেও সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিল ২০১১ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আনোয়ার হোসেনের নেতৃত্বে একটি কমিটি করেছিল। সেই কমিটি ২০১২ সালে ৮৬ দফা সুপারিশ দিয়েছিল। এসব সুপারিশ বাস্তবায়নে কোনো বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। এর আগে এইচ এম এরশাদ সরকারের আমলে ১৯৮২ সালে আরেকটি কমিটি পরিবহন খাত নিয়ে সুপারিশ করেছিল। শাজাহান খানের কমিটি এই দুটি সুপারিশের ওপর ভিত্তিতে কিছু বিষয় যোগ করে সুপারিশমালা তৈরি করেছে।

২০১৭ সালে ঢাকার গণপরিবহনে শৃঙ্খলার জন্য বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) পরিচালক শেখ মাহবুব ই রব্বানীর নেতৃত্বে আরেকটি কমিটি ৬টি সুপারিশ ও ২২টি পর্যবেক্ষণ দিয়েছিল।

এগুলোও বাস্তবায়ন হয়নি। নতুন সুপারিশে এগুলোও আছে। গত বছরের জুনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সড়ক দুর্ঘটনা রোধে পাঁচ দফা অনুশাসন দিয়েছিলেন। এর মধ্যে দূরপাল্লার পথের বাস-ট্রাকচালকের পাঁচ ঘণ্টা পর বিশ্রাম এবং আট ঘণ্টা পর বিকল্প চালক দিয়ে চালানোর বিষয়টি নিশ্চিত করতে বলা হয়েছিল। অবশ্য তা এখনো বাস্তবায়ন হয়নি। এখন শাজাহান খানের কমিটিতে এগুলো পুনরায় স্থান পেয়েছে।

প্রথম আলোর অনুসন্ধানে জানা গেছে, পরিবহন খাতে বছরে হাজার কোটি টাকার বেশি চাঁদাবাজি হয়। আর হাইওয়ে পুলিশের প্রতিবেদনে এসেছে, শুধু মহাসড়কে চলাচলকারী ৫৮ হাজার ৭১৯টি যানবাহন থেকে বছরে ৮৭ কোটি টাকা চাঁদা আদায় হচ্ছে।

সড়কে বিশৃঙ্খলার পেছনে পরিবহন খাতে চাঁদাবাজিকে বড় কারণ হিসেবে দেখা হয়। আর সড়কে প্রাণহানির পেছনে দায়ী চালকের বেপরোয়া গতি। চাঁদাবাজির মূলে আছে পরিবহন মালিক-শ্রমিক সংগঠনগুলো। গত বছর শিক্ষার্থীরা নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনে নামলে সরকার নতুন সড়ক পরিবহন আইন প্রণয়ন করে। এতে দুর্ঘটনার দায়ে চালকের শাস্তি-জরিমানা বৃদ্ধি করা হয়েছে। আইনটি বাস্তবায়ন হলে শাস্তি-জরিমানাও বেশি হবে। ফলে আইনটি হওয়ার পর থেকেই তা বাস্তবায়নে বাধা দিয়ে আসছে মালিক-শ্রমিক সংগঠনগুলো। তাদের চাপে আইনটি এখন শিথিল করার পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার।

সেই মালিক-শ্রমিকনেতানির্ভর কমিটিই সড়কে শৃঙ্খলা আনতে ও সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে নতুন করে সুপারিশ জমা দিল। ২২ সদস্যের কমিটির প্রধান শাজাহান খান শ্রমিকদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের কার্যকরী সভাপতি। সদস্য তালিকায় প্রথম নামটি মশিউর রহমানের। তিনি সারা দেশের পরিবহনমালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতির সভাপতি। এর বাইরে আরও ছয়জন সদস্য বাস-ট্রাক মালিক ও শ্রমিকদের সংগঠনের নেতা। বাকিরা সরকারের বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধি। দুজন প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আর চারজন নাগরিক প্রতিনিধি রয়েছেন। তবে এই কমিটির কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, সুপারিশে মালিক-শ্রমিকদের বিপক্ষে যায়—এমন বিষয় এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। অবকাঠামো নির্মাণ ও সচেতনতা বৃদ্ধির ওপরই বেশি জোর দেওয়া হয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে গতকাল শুক্রবার শাজাহান খান প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের দেওয়া সুপারিশ বাস্তবায়ন করার জন্য পাঁচ-সাতটা মন্ত্রণালয়ের দরকার পড়বে। তাই একটি শক্তিশালী কর্তৃপক্ষ করার সুপারিশ করেছেন। কর্তৃপক্ষ এক বছর আন্তরিকভাবে কাজ করলে সুফল পাওয়া যাবে। চাঁদাবাজির বিষয়টি সুপারিশে না আনার বিষয়ে তিনি বলেন, এটা ভিন্ন সমস্যা। এর সঙ্গে মালিক-শ্রমিক, পুলিশ, স্থানীয় রাজনীতি—নানা কিছু আছে। এ বিষয়ে সরকারের সঙ্গে তাঁর কথা হয়েছে। এটা ভিন্নভাবে আরেকটি প্রতিবেদনে তুলে ধরা হবে।

সড়ক আইনের বিষয়টি সম্পর্কে শাজাহান খান বলেন, আইনটি নিয়ে তিন মন্ত্রী কাজ করছেন। শিগগিরই হয়ে যাবে। এ জন্য এটা সুপারিশে এড়িয়ে গেছেন।

পরিবহনে চাঁদাবাজির নানা পদ্ধতি

প্রথম আলোর অনুসন্ধানে দেখা গেছে, পরিবহন খাতে তিন পদ্ধতিতে চাঁদা তোলা হয়। এগুলো হচ্ছে: ১. দৈনিক মালিক-শ্রমিক সংগঠনের নামে চাঁদা, ২. বাস-মিনিবাস নির্দিষ্ট পথে নামানোর জন্য মালিক সমিতির চাঁদা এবং ৩. রাজধানী ও এর আশপাশে কোম্পানির অধীনে বাস চালাতে দৈনিক ওয়েবিল বা গেট পাস (জিপি) চাঁদা।

বর্তমানে মালিক ও শ্রমিক সংগঠনগুলোর নামে প্রতিদিন প্রতিটি বাস-ট্রাক থেকে প্রকাশ্যে চাঁদা তোলা হয় ৭০ টাকা করে। সারা দেশের প্রায় পৌনে তিন লাখ বাস, মিনিবাস ও ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান থেকে দিনে প্রায় দুই কোটি টাকা চাঁদা ওঠে।

এর বাইরে ঢাকাসহ সারা দেশে বাস নামানোর আগেই মালিক সমিতির সদস্য পদ নিতে হয়। এর জন্য ২ থেকে ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত চাঁদা দিতে হয়। অর্থাৎ বিআরটিএ থেকে বাস নামানোর অনুমতির আগেই মোটা অঙ্কের চাঁদা দিয়ে মালিক সমিতির সদস্য হতে হয়। বিআরটিএ সূত্র বলছে, এ জন্য সারা দেশে বাস-মিনিবাসের অন্তত ৩০-৪০ শতাংশ পুরোনো, জীর্ণশীর্ণ। নতুন বাস-ট্রাক নামাতে পারেন না মালিকেরা। শাজাহান খানের নেতৃত্বে কমিটি পুরোনো বাস-মিনিবাস ও ট্রাকের পরিবর্তে নতুন বাস নামানোর সুপারিশ করেছে।

ঢাকা ও এর আশপাশে প্রায় সব বাসই চলে নির্দিষ্ট কোম্পানির অধীনে। সরকারদলীয় প্রভাবশালী নেতারা প্রথমে একটি কোম্পানি খোলেন। এর মধ্যে বিভিন্ন মালিকেরা বাস চালাতে দেন। বিনিময়ে বাসপ্রতি ৭০০ থেকে ১ হাজার ৭০০ টাকা পর্যন্ত চাঁদা দিতে হয়। প্রতিদিন চাঁদা ওঠে প্রায় এক কোটি টাকা। ঢাকায় বাস চলে প্রায় আট হাজার।

 বিপুল পরিমাণ চাঁদা দেওয়ায় বাড়তি আয়ের লক্ষ্যে মালিকেরা তাঁদের বাস চুক্তিতে চালক ও চালকের সহকারীর হাতে ছেড়ে দেন। এ জন্য চালকেরা বাড়তি যাত্রী, বাড়তি আয়ের লক্ষ্যে রাস্তায় পাল্লাপাল্লিতে লিপ্ত হন। এটাকে পরিবহন খাতের শৃঙ্খলার পথে বড় বাধা এবং সড়ক দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে মনে করা হয়।

সড়ক আইন উপেক্ষিত

সড়কে প্রতিদিনই ঝরছে প্রাণ। নিরাপদ সড়কের দাবিতে সোচ্চার বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির হিসাব অনুযায়ী, গত বছর সড়ক দুর্ঘটনায় ৭ হাজার ২২১ জন মারা গেছে। পুলিশের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে সড়ক দুর্ঘটনার গবেষণা করে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউট (এআরআই)। তাদের তথ্য বলছে, দেশে ৫৩ শতাংশ সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে অতিরিক্ত গতিতে গাড়ি চালানোর জন্য। আর চালকদের বেপরোয়া মনোভাবের কারণে দুর্ঘটনা ঘটে ৩৭ শতাংশ। অর্থাৎ চালকের বেপরোয়া মনোভাব ও গতির কারণে ৯০ শতাংশ দুর্ঘটনা ঘটছে। এ জন্য দুর্ঘটনায় দায়ী চালকের শাস্তি বৃদ্ধির দাবি করে আসছে সড়ক নিরাপত্তার জন্য সোচ্চার সংগঠনগুলো।

নতুন সড়ক পরিবহন আইনে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানির জন্য ৯৮ ও ১০৫ ধারায় শাস্তির বিধান আছে। ১০৫ ধারায় চালকের সর্বোচ্চ সাজা পাঁচ বছর, যা দণ্ডবিধি অনুসারে বিচার হবে। এই ধারায় সর্বোচ্চ পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করার বিধানও রয়েছে। আর ৯৮ ধারায় সর্বোচ্চ সাজা তিন বছরের কারাদণ্ড। এর বিচার হবে মোটরযান আইনে। এতে সর্বোচ্চ তিন লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডের বিধান আছে। জরিমানার একটি অংশ বা পুরোটা দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তকে দিতে পারেন আদালত। আইনে এই দুটি ধারা জামিন অযোগ্য। কিন্তু সড়কে শৃঙ্খলা আনার সুপারিশে আইন বাস্তবায়নের কোনো কথা নেই।

শাজাহান খানের নেতৃত্বাধীন কমিটিতে সদস্য হিসেবে ছিলেন পরিবহন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক সামছুল হক। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, যত সুপারিশই আসুক না কেন, তা বাস্তবায়নে রাজনৈতিক সদিচ্ছা প্রয়োজন। প্রথমে মালিকানাব্যবস্থা ভেঙে দিতে হবে। তাতে মালিক নেতাদের চাঁদাবাজি বন্ধ হয়ে যাবে। যানবাহন চালানোর বিষয়টি চাকরি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। অর্থাৎ নিয়োগপ্রাপ্ত চালক হতে হবে। এটা হলে শ্রমিকনেতাদের ক্ষমতা কমে যাবে। বর্তমান পরিবহনব্যবস্থায় নানা সুবিধাভোগী চক্র তৈরি হয়ে গেছে। এই চক্রে পেশিশক্তি, রাজনীতিক, এমনকি মাস্তানও আছে।