তরুণদের চুলে প্রশাসনের নজর

ইভ টিজিং আর যৌন হয়রানির ঘটনা নিয়ন্ত্রণে সব ছেড়েছুড়ে প্রশাসনের নজর এখন তরুণদের চুলের দিকে। কমপক্ষে আট জেলায় প্রশাসন, পুলিশ ও শিক্ষা কর্মকর্তারা কী করে চুল কাটতে হবে, তা নিয়ে নরসুন্দর সম্প্রদায়ের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। কোথাও কোথাও শাসিয়েছেন কিশোর-তরুণদেরও।

এ ক্ষেত্রে সেনাশাসনের আমলে কিশোর-তরুণদের লম্বা চুল সেলুনে নিয়ে কাটানোর ঘটনা কেউ কেউ স্মরণ করছেন। অনেকে আবার উত্তর কোরিয়ার দৃষ্টান্তও টানছেন। রেডিও ফ্রি এশিয়াকে উদ্ধৃত করে ২০১৪ সালে বিবিসি একটি প্রতিবেদনে বলেছিল, দেশটির প্রেসিডেন্ট কিম জং-উনের মতো চুল কাটতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। যুক্তরাজ্যের খ্যাতনামা সংবাদপত্র দ্য গার্ডিয়ান ‘নর্থ কোরিয়া’জ ফ্যাশন পুলিশ’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল ওই বছরের ২৪ এপ্রিল। প্রতিবেদনে বলা হয়, চুল কীভাবে কাটতে হবে, রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত টিভি লম্বা সময় ধরে তার প্রচার চালিয়েছে। সংবাদমাধ্যমের খবর উত্তর কোরিয়ায় নারীদের জন্য ১৮ ও পুরুষদের জন্য ১০ ধরনের চুল কাটার অনুমোদন আছে। সেলুনে কীভাবে চুল কাটতে হবে, তার ছবিও টাঙানো আছে। বাংলাদেশে অবশ্য এখনো ছবি টাঙানো হয়নি, তবে কোথাও কোথাও ক্যাটালগ সরিয়ে ফেলার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

>চুল কে কীভাবে কাটবে, কোনো নির্দেশনা দেয়নি পুলিশ সদর দপ্তর
দেশের সাতটি স্থানে চুল কাটার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার পরিপ্রেক্ষিতে গত বৃহস্পতিবার পুলিশ সদর দপ্তর সংশ্লিষ্ট এলাকার পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে কথা বলেছে। পুলিশ সদর দপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক (মিডিয়া) সোহেল রানা প্রথম আলোকে বলেন, চুল কে কীভাবে কাটবে, সে সম্পর্কে কোনো সিদ্ধান্তের ব্যাপারে পুলিশ সদর দপ্তর কাউকে কোনো নির্দেশনা দেয়নি। তবে দেশের বিভিন্ন স্থানে কিশোর গ্যাং ও কিশোর অপরাধীদের নিয়ন্ত্রণে কার্যকর আইনি ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে। আর প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলেছেন, চুল কাটা নিয়ে যা হওয়ার হয়ে গেছে। এসব নিয়ে যেন আর বাড়াবাড়ি না হয়।

বাংলাদেশে চুল নিয়ে টানাটানির এই ঘটনা নতুন নয়। ছয় মাসের কম সময়ের ব্যবধানে প্রশাসন ও পুলিশ আবারও তরুণদের চুল নিয়ে টানাটানি শুরু করেছে। এর আগে মার্চে প্রথম টাঙ্গাইলের ভূঞাপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ফ্যাশন করে চুল কাটলে ৪০ হাজার টাকা জরিমানা ধার্য করে সেলুনগুলোকে নোটিশ দেন। এরপর এ তালিকায় যুক্ত হন ঝালকাঠিতে পুলিশ ও সাভারের জনপ্রতিনিধিরা। নানা প্রশ্নের মুখে কিছুদিনের জন্য চুল কাটা নিয়ে নির্দেশনা জারি বন্ধ হয়। নতুন করে আবারও শুরু হয় চলতি বছরের জুলাই মাসে। এবার নাটোরের উপজেলা শিক্ষা অফিস, সিলেট, মাগুরায় পুলিশ এবং সব শেষ রাজশাহীর বাঘায় উপজেলা প্রশাসন ও পুলিশ বখাটে স্টাইলে চুল কাটার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে নরসুন্দরদের সঙ্গে বৈঠক করে।

জানতে চাইলে বাঘার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শাহীন রেজা প্রথম আলোকে বলেন, ‘জেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির বৈঠকে বিষয়টি উঠেছিল। বেশ কিছু অভিভাবকের অভিযোগ ছিল, ছেলেরা বখাটে স্টাইলে চুল কাটছে। এটা নিয়ে তাঁরা উদ্বিগ্ন। এর পরিপ্রেক্ষিতে জেলা প্রশাসক বলেছিলেন, ছেলেরা স্টাইল করলে করুক, কিন্তু বিদঘুটে যেন না লাগে। এটা নিয়ে এত আলোচনা হবে, বুঝতে পারিনি।’

সংশ্লিষ্ট তিনটি জেলায় কথা বলে জানা গেছে, কর্মকর্তারা মনে করেন, বখাটে স্টাইলে চুল কাটা কিশোর-তরুণেরা ইভ টিজিংয়ের মতো ঘটনায় জড়াচ্ছে।

তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক শেখ হাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, চুল কে কীভাবে কাটবে, সেটা ব্যক্তির অভিরুচি। এটা নিয়ে নির্দেশনা জারির মানে হলো সংবিধানের ৩১ ও ৩২ ধারার লঙ্ঘন। মানুষের জীবন ও ব্যক্তিস্বাধীনতার অধিকার এই দুটি ধারায় স্বীকৃত। স্টাইল করে চুল কাটার সঙ্গে ইভ টিজিং বা যৌন হয়রানির কোনো সম্পর্ক আছে বলে তিনি মনে করেন না। তিনি আরও বলেন, সৃষ্টিশীল মানুষের চুলের ছাঁটও সব সময় আর সবার মতো হয় না। কাজেই চুল কাটার সঙ্গে অপরাধের সম্পর্ক খোঁজার কোনো মানে হয় না।