জীবিকার সম্বল পেলেন রফিকুল

সর্বস্ব হারানো রফিকুলকে জীবিকার জন্য চায়ের দোকানের সরঞ্জাম দিয়ে সহায়তা করা হয়।
সর্বস্ব হারানো রফিকুলকে জীবিকার জন্য চায়ের দোকানের সরঞ্জাম দিয়ে সহায়তা করা হয়।

কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় তাঁর কবিতায় বলেছিলেন, ‘মানুষ বড় কাঁদছে, তুমি মানুষ হয়ে পাশে দাঁড়াও...।’ কবির এই বার্তা রিকশামিস্ত্রি রফিকুল ইসলাম হয়তো কোনো দিনই শোনেননি। কিন্তু তাতে কী? মানুষের স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্য নিয়ে তিনি চরমতম বিপদে মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। ১৬ আগস্ট মিরপুরের রূপনগর ঝিলপাড় বস্তির ভয়াবহ আগুনে পুড়েছে নিজের ঘর। হারিয়েছেন সর্বস্ব। এমন অবস্থায় হা-হুতাশ না করে রিকশামিস্ত্রি রফিকুল ইসলাম প্রতিবেশীদের ঘর রক্ষায় ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। আগুন নেভাতে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের সহযোগিতা করতে উঠে যান একটি দ্বিতল ভবনে। অচমকা পা ফসকে পড়ে যান নিচে। এতে তাঁর ডান পা ভেঙে যায়। চিড় ধরে মেরুদণ্ডের তিনটি হাড়ে। যখন তিনি চলনশক্তিহীন, তখন তাঁর পাশে এসে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিলেন একেবারেই অচেনা-অজানা একজন। রফিকুল পেলেন ঘুরে দাঁড়ানোর সম্বল।

 আগুনে সব হারানো রফিকুল ইসলামকে নিয়ে গত বুধবার প্রথম আলোয় ‘একজন রফিকুল ও ঝিলপাড় বস্তির অসহায় শিশুরা’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদনটি পড়ে নাম–পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যাংক কর্মকর্তা অসহায় রফিকুলের পাশে দাঁড়ানোর আগ্রহ প্রকাশ করেন।

তিনি যোগাযোগ করেন প্রথম আলোর সঙ্গে। পরে তাঁর সঙ্গে রফিকুলের যোগাযোগ করিয়ে দেওয়া হয়। রফিকুল যেন কিছু করে উপার্জন করতে পারেন, সে জন্য ওই ব্যাংক কর্মকর্তা গতকাল শনিবার একটি চায়ের দোকান করার যাবতীয় উপকরণ তাঁর হাতে তুলে দেন। এ সময় তিনি বলেন,‘রফিকুল ইসলামের সংবাদটা পড়ার পর রাতে ঘুমাতে পারিনি। বারবার তাঁর কথা, তাঁর ছোট ছোট তিনটি মেয়ের কথা মনে পড়ছিল। আমারও তাঁর মতো দুটো মেয়ে আছে। আর রফিকুল নিজের কথা না ভেবে অন্যের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়লেন। একে কী বলবেন! চরম ব্যক্তিকেন্দ্রিকতার এই যুগে রিকশাশ্রমিক রফিকুলের কাছ থেকে অনেক কিছু শেখার আছে। শুধু নিজেরটা নিয়ে ব্যস্ত না থাকা, সুখে-দুঃখে মানুষ হয়ে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর মতো মহান মানবিকতার শাশ্বত মূল্যবোধ তিনি ধারণ করেন। এই মানুষটির পাশে দাঁড়াতে পেরে আমি আত্মিকভাবে স্বস্তি পাচ্ছি।’

রফিকুলের তিন মেয়ে, দুই ছেলে ও স্ত্রী আয়েশাকে নিয়ে বড় সংসার। আয়েশা বেগম ঘরদোর সামলাতেন। আর রফিকুল ইসলাম উদয়াস্ত খেটেখুটে সবার ভাত-কাপড়ের সংস্থান করতেন। ১৬ আগস্ট মিরপুরের রূপনগর ঝিলপাড় বস্তিতে ভয়াবহ আগুনে সর্বস্ব হারানো আয়েশা বেগম স্বামীর পা ভেঙে যাওয়ায় চোখে অন্ধকার দেখছিলেন। তিনি বলেন ‘ছইল–পইলকে কী খাওয়ামু, তার উপর ওনার চিকিৎসা। কী দিয়া কী হইবো! ভাইবা কোনো কূল পাইছিলাম না। চিকিৎসার খরচ কমিশনার দিছে। আরও দিবে কইছে। আইজ খাওয়োনের জোগাড় পাইয়া বল পাইলাম।’

এদিকে সহযোগিতা পেয়ে খুশি রফিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘ডাক্তার কইছে ছয় মাস ঠিকমতো হাঁটাচলা করোন যাইব না। এই দুর্দিনে একটা চা–দোকান পাওয়ায় মনে হয় সবকিছু পাইছি। বউ দোকান চালাইব। আমি মাঝেমধ্যে বইসা থাইকা হাত লাগাইতে পারুম। ছইল-পইল লইয়া বাইচা থাকার একটা উপায় হইলো।’

গত বুধবার প্রথম আলোর ওই প্রতিবেদনে ঝিলপাড় বস্তিতে শিশুখাদ্যের চরম সংকটের কথাও তুলে ধরা হয়। গতকাল দেখা যায়, বঙ্গবন্ধু বিদ্যানিকেতনে আশ্রয় নেওয়া শিশুদের হাতে হাতে ডানো গুঁড়া দুধের মিনি প্যাকেট। দুই শিশু স্বর্ণা-সান্ত্বনা আপনমনে গুঁড়া দুধ খাচ্ছিল। তারা বলে, ‘দুপুরের দিকে একটা কোম্পানি থেকে দুধ দেয়া হয়েছে। চকলেট দুধ খেতে খুব মজা।’