১ থেকে ৩০ মিনিটে পাস হয়েছে ৭১ শতাংশ বিল

পার্লামেন্টওয়াচ নামের এই প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান। তাঁর পাশে টিআইবির চেয়ারম্যান সুলতানা কামাল। ছবি: প্রথম আলো
পার্লামেন্টওয়াচ নামের এই প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান। তাঁর পাশে টিআইবির চেয়ারম্যান সুলতানা কামাল। ছবি: প্রথম আলো

দশম জাতীয় সংসদে ৭১ শতাংশ বিল পাস হয়েছে ১ থেকে ৩০ মিনিটের মধ্যে। ৬০ মিনিটের বেশি সময় নিয়ে পাস হয়েছে মাত্র একটি বিল। দশম সংসদ নিয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) প্রকাশিত গবেষণা প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়েছে।

পার্লামেন্টওয়াচ নামের এই প্রতিবেদন আজ বুধবার টিআইবির ধানমন্ডির কার্যালয়ে উপস্থাপন করা হয়।
প্রকাশিত এই প্রতিবেদনে সংসদের আইন প্রণয়ন কার্যাবলি সম্পর্কে আরও বলা হয়েছে, ২১ থেকে ৪০ মিনিট সময়ের মধ্যে পাস হয়েছে ৪৫ শতাংশ বিল। ৮ শতাংশ বিল পাস হতে সময় লেগেছে ৪০ থেকে ৬০ মিনিট। ৪৬ শতাংশ বিল পাস হতে সময় লেগেছে ১ থেকে ২০ মিনিট।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সংসদের মোট ব্যয়িত সময়ের মধ্যে ১২ শতাংশ সময় ব্যয় হয়েছে আইন প্রণয়নের কাজে। তবে এই সময়ের মধ্যে বাজেট বিলটি অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। টিআইবির তথ্য অনুযায়ী, যুক্তরাজ্যের হাউস অব লর্ডসে আইন প্রণয়নে ব্যয় হয় ৪৮ শতাংশ সময় এবং ভারতের লোকসভায় এই হার ৩২ শতাংশ।

তবে দশম সংসদের এই চিত্র আগের চেয়ে কিছুটা ভালো। টিআইবি বলেছে, অষ্টম সংসদে আইন প্রণয়নে ব্যয় হয়েছিল ৯ শতাংশ সময় এবং নবমে ৮ শতাংশ।

দশম সংসদে সব মিলিয়ে ১৯৩টি বিল পাস হয়েছে। ১৬টি বেসরকারি বিল জমা পড়লেও পাস হয়নি একটিও। টিআইবির গবেষণা বলছে, প্রতিটি বিল পাস হতে গড়ে সময় লেগেছে ৩১ মিনিট করে। অন্যদিকে ভারতের লোকসভায় প্রতিটি বিল পাস হতে গড়ে ১৪১ মিনিট সময় লাগে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আইন প্রণয়নের কাজে মোট ব্যয়িত সময়ের মধ্যে ১১ শতাংশ সময় সরকারি দলের সদস্য, ৬৭ শতাংশ সময় প্রধান বিরোধী দল এবং ২২ শতাংশ সময় অন্যান্য বিরোধী দলের সদস্যরা ব্যয় করেছেন। এসব বিলের ওপর সংশোধনী ও যাচাই-বাছাইয়ের প্রস্তাবে বিরোধী দলের সদস্যরা তুলনামূলকভাবে সক্রিয় ছিলেন। তবে আগের বিভিন্ন সংসদের মতোই বিলের ওপর দেওয়া জনমত যাচাইয়ের প্রস্তাব কণ্ঠভোটে নাকচ হয়ে গেছে। কয়েকটি আলোচিত বিলে অংশীজনের মতামতের প্রতিফলন ঘটেনি। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, বৈদেশিক অনুদান রেগুলেশন বিল, ডিজিটাল নিরাপত্তা বিল, সড়ক পরিবহন বিল, বিচারপতিদের অভিশংসনের ক্ষমতা সংসদের কাছে নিয়ে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বিল।

অনুষ্ঠানে উপস্থিত টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, সংসদ বর্জন বন্ধ হয়েছে। তবে অনেক মূল্যের বিনিময়ে, মাথাব্যথার কারণে মাথা কেটে ফেলার মতো। তিনি আরও বলেন, বিরোধী দল কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারেনি। কারণ, তারা সরকারি না বিরোধী দলের, সেটা পরিষ্কার ছিল না। দ্বৈত পরিচয়ের কারণে তারা প্রকৃত ভূমিকা পালনে ব্যর্থ ছিল। আইন প্রণয়নের বিষয়গুলো অনেকে ভালোভাবে বোঝেন না। এ জন্য তাঁদের প্রশিক্ষণ দরকার। সব মিলিয়ে সুশাসন ও জবাবদিহির ব্যাপক ঘাটতি ছিল।

দশম সংসদের কার্যকাল ছিল ২০১৪ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৮ সালের অক্টোবর পর্যন্ত। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই সংসদে ১৫৩ জন সদস্য বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছিলেন। দেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি এই নির্বাচনে অংশ নেয়নি। যে কারণে সংসদে বিরোধী দলের দায়িত্ব পালনের সুযোগ পায় জাতীয় পার্টি। এই সংসদের ২৩টি অধিবেশনে মোট কার্যদিবস ছিল ৪১০, ব্যয়িত মোট সময় ছিল ১ হাজার ৪১০ ঘণ্টা ৯ মিনিট। সার্বিক এসব বিষয় নিয়ে গবেষণা প্রতিবেদনটি তৈরি করেন নিহার রঞ্জন রায় ও মোরশেদা আক্তার। তাঁরা দুজনই আজ প্রতিবেদন দুটি উপস্থাপন করেন।

গবেষণায় বলা হয়েছে, সাংসদের অনেকের মধ্যে কার্যপ্রণালিবিধি অনুযায়ী বক্তব্য ও মতামত তুলে ধরার ক্ষেত্রে দক্ষতার ঘাটতি ছিল। আইন প্রণয়নে সদস্যদের অংশগ্রহণ ছিল কম। এর কারণ খসড়া বিল পর্যালোচনার জন্য পূর্বপ্রস্তুতি না থাকা এবং আইনসম্পর্কিত বিষয়ে অনাগ্রহ। রাষ্ট্রপতির ভাষণের মাধ্যমে বাংলাদেশের সঙ্গে অন্যান্য দেশের আন্তর্জাতিক চুক্তিগুলো সংসদে উপস্থাপন করার সাংবিধানিক বিধান থাকলেও দশম সংসদে তা করা হয়নি।

আজকের অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন টিআইবির চেয়ারম্যান সুলতানা কামাল।

দলভিত্তিক অংশগ্রহণ:
দলভিত্তিক অংশগ্রহণে দেখা যায়, আইন প্রণয়নে সরকারি দলের ৭১ জন, বিরোধী দলের ১৯ জন এবং অন্যান্য দলের ৪ জন অংশ নেন। তবে বাজেট আলোচনায় সরকারি দলের ২৫৫ জন, প্রধান বিরোধী দলের ৩৭ জন এবং অন্যান্য দলের ১৭ জন অংশ নেন।

প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, প্রতি কার্যদিবসে সদস্যদের গড় উপস্থিতি ছিল ৬৩ শতাংশ। এর মধ্যে নারী সদস্যদের উপস্থিতি ছিল ৭১ শতাংশ এবং পুরুষের ৬২ শতাংশ। ৭৫ শতাংশের বেশি কার্যদিবসে উপস্থিত ছিলেন সরকারি দলের ৩১ শতাংশ সদস্য এবং বিরোধী দলের ৩১ শতাংশ। সংসদ নেতার উপস্থিতি ছিল ৮২ শতাংশ কার্যদিবসে এবং বিরোধীদলীয় নেতার ৫৯ শতাংশ।

ওয়াকআউট ও কোরাম সংকট:
দশম সংসদে অধিবেশন বর্জনের ঘটনা ঘটেনি। তবে বিরোধী দল ১৩ বার ওয়াকআউট করেছিল। অনির্ধারিত আলোচনায় কথা বলার সুযোগ না দেওয়া এবং পুড়িয়ে মানুষ মারার অভিযোগে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে হুকুমের আসামি না করার প্রতিবাদে তারা এসব ওয়াকআউট করে।
প্রতিদিন গড়ে ২৮ মিনিট করে কোরাম সংকট ছিল। এই হিসাব আগের সংসদের তুলনায় কিছুটা কম। সব মিলিয়ে ২৩টি অধিবেশনে কোরাম সংকটে কেটেছে মোট ১৯৪ ঘণ্টা ৩০ মিনিট, যার প্রাক্কলিত অর্থমূল্য ১৬৩ কোটি ৫৭ লাখ ৫৫ হাজার ৩৬৩ টাকা বলে গবেষণায় বলা হয়েছে। অষ্টম ও নবম সংসদে গড়ে কোরাম সংকট ছিল যথাক্রমে ৩৭ মিনিট ও ৩২ মিনিট।

নিয়মিত সভা করেনি সংসদীয় কমিটি:
অতীতের মতো দশম সংসদেও সংসদীয় কমিটিগুলো নিয়মিত সভা করতে পারেনি। টিআইবির গবেষণায় দেখা যায়, বিধি অনুযায়ী ৫০টি সংসদীয় কমিটির প্রতি মাসে একটি করে মোট ৩ হাজারটি সভা করার কথা। বাস্তবে ৪৮টি কমিটি ১ হাজার ৫৬৬টি সভা করেছে। বিধি অনুযায়ী প্রতি মাসে একটি করে সভা করেছে সরকারি হিসাব–সংক্রান্ত কমিটি ও নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়–সম্পর্কিত কমিটি। সংসদের কার্যপ্রণালিবিধি ও বিশেষ অধিকার–সম্পর্কিত কমিটির কোনো বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়নি। সর্বোচ্চ ১০৮টি সভা করেছে সরকারি হিসাব–সম্পর্কিত কমিটি। সর্বনিম্ন দুটি সভা করেছে পিটিশন কমিটি। আটটি কমিটিতে সভাপতিসহ সদস্যদের কমিটি–সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়িক সম্পৃক্ততা ছিল। কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়নের হার ৪৫ শতাংশ।

অষ্টম ও নবম সংসদে সুপারিশ বাস্তবায়নের হার ছিল যথাক্রমে ৫৮ ও ৪৩ শতাংশ।

সদস্যদের আচরণ:
সুশীল সমাজের প্রতিনিধি ও সংসদের বাইরের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে অশ্লীল ও আক্রমণাত্মক শব্দ হিসেবে বেয়াদব, হারামজাদা, লম্পট, কুলাঙ্গার, মোনাফেক, রক্তচোষা মহিলা—ইত্যাদি অসংসদীয় শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে বলে টিআইবির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। আরও বলা হয়েছে, অধিবেশন চলাকালে সদস্যদের অনেককে মোবাইল ফোন নিয়ে ব্যস্ত থাকতে দেখা যায়, বসে বসে ঝিমোতেও দেখা যায়। এসব ক্ষেত্রে বিধি অনুযায়ী শৃঙ্খলা রক্ষার ক্ষেত্রে স্পিকারের ভূমিকায় ঘাটতি ছিল।

সার্বিক পর্যবেক্ষণ:
গবেষণায় বলা হয়েছে, বিরোধী দল আর্থিক খাতে অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়ে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। কিন্তু বিরোধী দলের পাশাপাশি সরকারের অংশ হওয়ায় সংসদে তারা পরিচিতির সংকটে ভুগেছে। যে কারণে তারা এ বিষয়ে জোরালো ভূমিকা রাখতে পারেনি।

প্রধান একটি দলের অংশগ্রহণ না থাকায় সংসদ অংশগ্রহণমূলক ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হয়নি বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, একই কারণে সংসদে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে একচ্ছত্র ক্ষমতার চর্চা বৃদ্ধি পেয়েছে। কার্যকর বিরোধী দলের অনুপস্থিতি ও স্পিকারের জোরালো ঘাটতির কারণে সংসদ প্রত্যাশিত পর্যায়ে কার্যকর ছিল না। বিরোধী দলের আত্মপরিচয়ের সংকট এবং তাদের দ্বৈত অবস্থানের কারণে সরকারের কাছ থেকে জবাবদিহি আদায়ে তারা প্রত্যাশিত ভূমিকা রাখতে পারেনি।