জাতীয় পর্যায়ে সমন্বয় দরকার

গোলটেবিল বৈঠকে বক্তব্য দেন বাংলাদেশ জাতীয় পুষ্টি পরিষদের মহাপরিচালক মো. শাহ নেওয়াজ। পাশে জাতীয় পুষ্টি সেবার লাইন ডিরেক্টর এস এম মোস্তাফিজুর রহমান।  ছবি: প্রথম আলো
গোলটেবিল বৈঠকে বক্তব্য দেন বাংলাদেশ জাতীয় পুষ্টি পরিষদের মহাপরিচালক মো. শাহ নেওয়াজ। পাশে জাতীয় পুষ্টি সেবার লাইন ডিরেক্টর এস এম মোস্তাফিজুর রহমান। ছবি: প্রথম আলো

আগের তুলনায় দেশের পুষ্টি পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। উন্নতির ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে নেওয়া হয়েছে বহু খাতভিত্তিক জাতীয় পুষ্টি পরিকল্পনা। তবে পুষ্টি নিয়ে টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জন করতে জাতীয় পর্যায়ে বিভিন্ন প্রকল্পের সমন্বয় দরকার।

গতকাল বুধবার বিকেলে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত ‘বহু খাতভিত্তিক জাতীয় পুষ্টি কর্মপরিকল্পনা-২: বাস্তবায়ন, চ্যালেঞ্জ ও করণীয়’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে আলোচকেরা এসব কথা বলেন। কনসার্ন ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ও সিভিল সোসাইটি অ্যালায়েন্স ফর সানের (সিএসএ ফর সান) সহযোগিতায় এ বৈঠকের আয়োজন করে প্রথম আলো। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম।

গোলটেবিল বৈঠকে আলোচকেরা বলেন, সরকার কয়েক দশক ধরে দেশের অপুষ্টি দূর করতে বহুমুখী কাজ করছে। তবু পুষ্টি পরিস্থিতি নিচের দিকে রয়েছে এমন দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ২০১৭ সালে বহু খাতভিত্তিক জাতীয় পুষ্টি কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে।

জনবলসংকটসহ নানা ধরনের সমস্যার পরেও বহু খাতভিত্তিক পরিকল্পনার কারণে পুষ্টি পরিস্থিতির অগ্রগতি হয়েছে বলে মন্তব্য করেন বাংলাদেশ জাতীয় পুষ্টি পরিষদের (বিএনএনসি) মহাপরিচালক মো. শাহ্ নেওয়াজ। তিনি বলেন, পুষ্টি কার্যক্রম গতিশীল করতে জেলা-উপজেলায় সমন্বয় কমিটি গঠন করা হয়েছে। পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ২২টি মন্ত্রণালয়কে যুক্ত করা হয়েছে। এ খাতে বরাদ্দও আগের চেয়ে বাড়ানো হয়েছে।

জনস্বাস্থ্য পুষ্টি প্রতিষ্ঠানের জাতীয় পুষ্টি সেবার লাইন ডিরেক্টর এস এম মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, বহু খাতভিত্তিক পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন যেমন দরকার, একইভাবে যারা অপুষ্টিতে ভুগছে, তাদের সঙ্গে কথা বলে মূল সমস্যা চিহ্নিত করা জরুরি। সামাজিকভাবে বিষয়টি মোকাবিলা করতে হবে।

কোনো দেশের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির সঙ্গে জনগোষ্ঠীর স্থূলতাও চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দেয় বলে মন্তব্য করেন বাংলাদেশ ব্রেস্ট ফিডিং ফাউন্ডেশনের চেয়ারপারসন এস কে রায়। তিনি বলেন, এ সময় অসংক্রামক ব্যাধি, শিশু ও প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে স্থূলতার ঝুঁকি বেড়ে যায়। দেশে ধনীদের মধ্যে ২০ শতাংশ মানুষ স্থূলতার সমস্যায় ভুগছে বলে তিনি জানান।

বিএনএনসির সহকারী পরিচালক মো. নাজমুস সালেহীন পুষ্টি পরিস্থিতি নিয়ে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। এতে বলা হয়, বাংলাদেশ পুষ্টির বিভিন্ন সূচকে উন্নতি করলেও কম ওজনের শিশুর জন্ম, স্বল্প ওজন, খর্বাকৃতির শিশুর জন্ম এখনো হচ্ছে। শিশু জন্মের প্রথম ছয় মাসে শুধু বুকের দুধ খাওয়ানোর হার প্রত্যাশিত মানে পৌঁছাতে পারেনি। 

প্রকল্পের সঠিক মনিটরিংয়ের জন্য তথ্য ভান্ডারের বড় ভূমিকা রয়েছে। এ বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে বলে মনে করেন বিএনএনসির সহকারী পরিচালক আকতার ইমাম। 

এসডিজি অর্জনে প্রতিটি মন্ত্রণালয়ের জন্য পৃথকভাবে পুষ্টিবিষয়ক কাজ নির্ধারণ করে দেওয়া জরুরি বলে মন্তব্য করেন ইউনিসেফের পুষ্টিবিষয়ক কর্মকর্তা আসফিয়া আজিম।

প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের স্বাস্থ্য উপদেষ্টা ইখতিয়ার উদ্দিন খন্দকার বলেন, জেলা-উপজেলায় পুষ্টি কার্যক্রমের জন্য কমিটি থাকলেও ইউনিয়ন পর্যায়ে নেই। ফলে তৃণমূলে পুষ্টি পরিস্থিতির উন্নয়নে একটা ফাঁক থেকে যাচ্ছে। প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল উত্তরবঙ্গে ইউনিয়ন পর্যায়ে পরীক্ষামূলক প্রকল্প চালাচ্ছে।

দেশে খাদ্যের সরবরাহ ও খাবার কেনার সামর্থ্য বাড়লেও খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে বলে জানান ফুড প্ল্যানিং অ্যান্ড মনিটরিং ইউনিটের সহযোগী গবেষণা পরিচালক মোস্তফা ফারুক আল-বান্না। 

পুষ্টি পরিস্থিতির উন্নয়নে ব্যক্তি খাতের অংশগ্রহণ দরকার বলে মনে করেন ফুড অ্যান্ড অ্যাগ্রিকালচার অর্গানাইজেশনের পুষ্টি উপদেষ্টা এম এ মান্নান। তিনি বলেন, পুষ্টি পরিস্থিতির উন্নতি না হলে হাসপাতালের সংখ্যা বাড়বে। স্বাস্থ্য খাতে মানুষের ব্যয় বাড়বে। 

অ্যালাইভ অ্যান্ড থ্রাইভের পরামর্শক মোহসীন আলী বলেন, ২০৫০ সাল নাগাদ দেশের অর্ধেক লোক শহরে বাস করবে, যার কিছু নেতিবাচক প্রভাব রয়েছে। এ জন্য শহরের দরিদ্র লোক বা বস্তিবাসীকে পুষ্টি প্রকল্পের আওতায় নেওয়া দরকার।

পুষ্টি পরিস্থিতি উন্নয়নে ঘরে ঘরে যেতে হবে বলে মন্তব্য করেন ব্র্যাকের কর্মসূচিপ্রধান (পুষ্টি) সায়কা সিরাজ। 

কেয়ার বাংলাদেশের টিম লিডার (সিআই-৪-এন) নাজনীন রহমান বলেন, পুষ্টি প্রকল্পের সঙ্গে স্থানীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের যুক্ত করতে পারলে দ্রুত পরিস্থিতির পরিবর্তন আসবে। 

পুষ্টি পরিস্থিতির উন্নয়নে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘ—তিন মেয়াদে কর্মপরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে বলে জানান সেভ দ্য চিলড্রেন ইন বাংলাদেশের (হেলথ অ্যান্ড নিউট্রিশন) সিনিয়র টেকনিক্যাল অ্যাডভাইজার রাইসুল হক।

গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ইমপ্রুভড নিউট্রিশনের পোর্টফোলিও লিড মনিরুজ্জামান বিপুল বলেন, দেশে খাদ্য উৎপাদন ও জোগানের ক্ষেত্রে বিবেচনায় থাকে আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার বিষয়টি। কিন্তু খাদ্যে পুষ্টি নিশ্চিত করতে এর পরিবর্তন জরুরি।

কনসার্ন ওয়ার্ল্ড ওয়াইডের পুষ্টি উপদেষ্টা মো. আমির হোসেন বলেন, পুষ্টি পরিস্থিতির উন্নতিতে স্থানীয় পর্যায়ে জবাবদিহির সংস্কৃতি গড়ে তুলতে সংস্থাটির পক্ষ থেকে মুক্ত আলোচনাসহ নানা ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।