একটি স্বপ্নের মৃত্যু

একমাত্র ছেলে রাকিবুল হাসানকে (১৩) ঘিরে গরিব বাবা-মায়ের স্বপ্ন ছিল। পড়ালেখা শিখে ছেলে একদিন প্রকৌশলী হবে। অভাব ঘুচাবে পরিবারের। কিন্তু খেজুর রসের গরম কড়াইয়ে দগ্ধ হয়ে সেই স্বপ্নের মৃত্যু ঘটেছে।
নাটোরের গুরুদাসপুর উপজেলার ধারাবারিষা ইউনিয়নের সিধুলিমধ্যমপাড়া গ্রামের কৃষিশ্রমিক জয়নাল মোল্লা ও রোকেয়া বেগমের একমাত্র ছেলে রাকিবুল হাসান। গুরুদাসপুর মডেল পাইলট উচ্চবিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র। তার ছোট বোন জেবা সিধুলি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রথম শ্রেণির শিক্ষার্থী।
রাকিবের চাচাতো ভাই মিজানুর রহমান জানান, গত সোমবার সকাল সাতটার দিকে রাকিবের বাবা-মা তাদের বাড়ির উঠানে খেজুর রস জ্বাল দিয়ে গুড় তৈরিতে ব্যস্ত ছিলেন। এ সময় রাকিবুল তাদের সহযোগিতার জন্য খড় (ধানগাছের নাড়া) জোগান দিতে ব্যস্ত ছিল। অসাবধানতাবশত রাকিবের শরীরে জড়ানো কাপড়ে আগুন লেগে যায়। কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই রাকিবুল খেজুর রসের গরম কড়াইয়ে পড়ে মারাত্মকভাবে দগ্ধ হয়। ওই দিনই তাকে গুরুদাসপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়।
গুরুদাসপুর হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা রবিউল করিম জানান, রাকিবের দুই হাত ও শরীরের পেছন অংশের প্রায় ৬০ ভাগ দগ্ধ হয়। পরিস্থিতি আশঙ্কাজনক বিবেচনায় ওই দিনই তাকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়।
রাকিবের প্রতিবেশী স্কুলশিক্ষক নজরুল ইসলাম জানান, রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের ৩৮ নম্বর বেডে রাকিব চিকিৎসাধীন ছিল। গত শুক্রবার রাত আটটার দিকে তার মৃত্যু হয়। গতকাল শনিবার সকাল ১০টার দিকে সিধুলি কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।
গতকাল শনিবার দুপুরে সিধুলিমধ্যমপাড়া গ্রামে গিয়ে দেখা গেছে, রাকিবুলের মা রোকেয়া বেগম সন্তানের শোকে পাগলপ্রায়। নানা রকম প্রলাপ বকছেন। প্রতিবেশীরা তাঁকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছেন। মাঝেমধ্যেই তিনি মূর্ছা যাচ্ছেন। তাঁর ছোট মেয়ে জেবা এক আত্মীয়ের কোলে। ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রয়েছে। বাবা জয়নাল মোল্লা রস জ্বাল দেওয়া চুলার পাশে নিশ্চুপ বসে রয়েছেন।
অনেকক্ষণ পর জয়নাল মোল্লা জানালেন, তাঁর নিজের জমিজমা নেই। অন্যের জমিতে কৃষিকাজ করেন এবং কিছু জমি বর্গা নিয়ে কোনোরকমে সংসার চালান। বাড়তি আয়ের জন্য খেজুরগাছ থেকে রস সংগ্রহ করে গুড় তৈরি করতেন। এ কাজে তার একমাত্র ছেলে সহযোগিতা করত। অনেক কষ্টের মাঝেও একমাত্র ছেলেকে প্রকৌশলী করার স্বপ্ন দেখতেন। কিন্তু একটু অসাবধানতায় সব স্বপ্ন শেষ হয়ে গেল।
ধারাবারিষা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আবদুল মতিন জানান, গবির হলেও ছেলেকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন ছিল জয়নাল মোল্লার। কিন্তু ছেলের মৃত্যুর কারণে পরিবারটির একটি স্বপ্নের মৃত্যু ঘটেছে।