কেঁচো সারে বিষমুক্ত সবজি

রাসায়নিক সার মাটির উর্বরতা শক্তি নষ্ট করে। এই সার ব্যবহার করে উৎপাদিত ফসলও মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। তাই প্রত্যন্ত এলাকার অনেক নারী কেঁচো সার তৈরির দিকে ঝুঁকছেন। প্রাকৃতিক উপায়ে এই সার তৈরি করা যায়। পাশাপাশি এই সার উৎপাদন করে লাভবানও হওয়া যায়।
নানা ধরনের উপকারিতা থাকায় নারীরা ফরিদপুর সদরের কানাইপুর ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামের নারীরাও এই সার তৈরির সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। সাড়ে তিন বছর আগে ইউনিয়নের শোনপচা গ্রামে প্রথমে কেঁচো সার তৈরি করা শুরু করেন পাঁচ নারী। শোনপচা গ্রামে নারীদের এ সাফল্য দেখে কানাইপুর ইউনিয়নের শোলাকুণ্ডু, মৃগী, সাইবেরিয়া, বসু নরসিংহদিয়াসহ বিভিন্ন গ্রামের ৬৫ জন নারী এই সার তৈরি করছেন।

কেঁচো সার একধরনের জৈব সার। রাসায়নিক সারের মতো এই সার জমির উর্বরতা শক্তি নষ্ট করে না, বরং উর্বরতা শক্তি বাড়ায়। রাসায়নিক সার দিয়ে উৎপাদিত সবজি বা ফসলে রাসায়নিক সারের উপাদান থেকে যায়; যা শরীরের জন্য ক্ষতিকর। পক্ষান্তরে, জৈব সার দিয়ে উৎপাদিত সবজি বা ফসলে কোনো বিষাক্ত উপাদান থাকে না। এককথায় জৈব সার দিয়ে উৎপন্ন পণ্য বিষমুক্ত। এই সারে উৎপাদিত গাছ সতেজ হয়, সবজির মানও হয় খুব ভালো।

কয়েকজন নারী উদ্যোক্তা সঙ্গে কথা বলে জানা গেল এই সার তৈরির আদ্যোপান্ত। এ সার তৈরি করার প্রক্রিয়াও বেশ সহজ। প্রথমে গোবর সংগ্রহ করে ২৫ থেকে ৩০ দিন একটি সিমেন্টের রিংয়ের মধ্যে স্তূপ করে রাখা হয়। এরপর গোবরের মধ্যে কেঁচো ছেড়ে দেওয়া হয়। কেঁচো ছেড়ে দেওয়ার ২৫ দিনের মধ্যে সার তৈরি হয়ে যায়। তবে প্রথমবার কেঁচো ছেড়ে দেওয়ার পর সার পেতে ২৫ দিন সময় লাগলেও পরবর্তীকালে সময় কমে ১৫–১৬ দিনে নেমে আসে।

এ সার উৎপাদনে খরচ খুব কম। যাদের গরু আছে, তাদের খরচ আরও কম। চার–পাঁচটি রিং গ্রহ করতে হয়। প্রতিটি রিংয়ের মূল্য ২০০ টাকা করে। প্রথম দফায় এক হাজার থেকে এক হাজার পাঁচশ টাকার কেঁচো কিনতে পারলেই হলো। কেঁচোর খরচ ওই একবারই। এরপর বছরের পর বছর চালিয়ে গেলেও কেঁচো কিনতে হয় না। কেঁচো ডিম পেড়ে প্রতিনিয়ত বাচ্চা দেয়, পরে সারের পাশাপাশি কেঁচোও বিক্রি করা হয়। সিমেন্টের একটি রিং স্ল্যাব ভেঙে না যাওয়া পর্যন্ত সেটি দিয়ে কাজ করা যায়।

ফরিদপুর সদরের কানাইপুর ইউনিয়নের শোনপচা গ্রামে ঘুরে দেখা গেছে, ওই গ্রামের অন্তত পাঁচজন নারী জৈব সার উৎপাদন ও বিপণন করছেন। তাঁদের মধ্যে একজন খোয়াজ শেখের স্ত্রী আম্বিয়া বেগম বলেন, চার বছর আগে একটি প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতে গিয়ে তিনি রাসায়নিক সারের অপকারিতা ও জৈব সারের উপকারিতা সম্পর্কে জানতে পারেন। ওই প্রশিক্ষণ নেওয়ার পর তিনি বুঝতে পারেন, তাঁরা রাসায়নিক সার দিয়ে উৎপাদিত বিষাক্ত শাকসবজি খাচ্ছেন। তাই বিষমুক্ত শাকসবজি পেতে তিনি কেঁচো সার তৈরি শুরু করেন। তিন বছর ধরে তিনি এ সার উৎপাদন করছেন। তিনি আরও জানান, সার উৎপাদন করে বুঝেছি যে এই সার উৎপাদন করা লাভজনক। ঘরে বসে নিজেদের একটু পরিশ্রমে এ সার উৎপাদন করা যায়। ক্রেতারা বাড়িতে এসে প্রতি কেজি ১০ টাকা দিয়ে সার কিনে নিয়ে যান।

দুই ছেলের মা আম্বিয়া বেগম। বড় ছেলে শফিকুল শেখ ফরিদপুরের সরকারি রাজেন্দ্র কলেজের স্নাতকোত্তর শ্রেণির শিক্ষার্থী। ছোট ছেলে সাগর শেখ কানাইপুর উচ্চবিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী। স্বামী ছোট একটি ব্যবসা করেন। আম্বিয়া বেগম জানান, স্বামীর একক আয়ে সংসার চালানো কষ্ট হচ্ছিল। এখন কেঁচো সার বিক্রির টাকা দিয়ে তিনি তাঁর স্বামীকে সংসার চালাতে সহায়তা করছেন। ছেলেদের হাতখরচের জোগান তিনিই দিতে পারেন।

কেঁচো সার উৎপাদন ও বিপণন করে লাভবান হয়েছেন ওই গ্রামের কৃষক ছকেন ফকিরের স্ত্রী জামেলা বেগম (৩৯)। দুই মেয়ে ও এক ছেলের মা জামেলা ইতিমধ্যে তাঁর এক ছেলে ও এক মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। ছোট মেয়ে শিউলি নবম শ্রেণিতে পড়ে।

জামেলা জানান, প্রতি সপ্তাহে তিনি প্রায় ১০০ কেজি সার বিক্রি করেন। প্রতি কেজি সার ১০ টাকা দরে বিক্রি হয়। সার বিক্রি করে মাসে চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা আয় করা সম্ভব। আম্বিয়া বা জামেলা বেগমের মতো কেঁচো সার তৈরি করে শোনপচা গ্রামের সালাম শেখের স্ত্রী ছবুরা বেগম, সাহেব আলীর স্ত্রী মমতাজ বেগম ও আইউব আলীর স্ত্রী জয়গুন বেগম স্বাবলম্বী হয়েছেন।

এ বিষয়ে ফরিদপুর সদরের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা মুজাহিদুল ইসলাম বলেন, শোনপচা গ্রাম থেকে জৈব সার তৈরি শুরু হলেও এখন কানাইপুরের শোলাকুণ্ডুসহ বিভিন্ন গ্রামে ব্যাপকভাবে এ সার উৎপাদন করা হচ্ছে। এ সার তৈরিতে আফ্রিকা থেকে আনা এপিজিক ও এন্ডোজিক প্রজাতির কেঁচো ব্যবহার করা হয়। তিনি বলেন, ফরিদপুরে প্রথমে একটি বেসরকারি সংস্থা এ কেঁচো আনে। বর্তমানে কৃষকেরাই কেঁচো বিক্রি করতে পারছেন।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক কার্তিক চন্দ্র চক্রবর্ত্তী বলেন, কেঁচো সার ফরিদপুরে দিনে দিনে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। বিভিন্ন ইউনিয়ন ও গ্রামে এ সার তৈরি হচ্ছে। খরচ কম এবং লাভজনক হওয়ায় মানুষ এ সার উৎপাদনে আগ্রহী হয়ে উঠছে।