বাস চালানোর প্রথম দিনই কৃষ্ণার পায়ে চাপা দেন চালক

বাসচালক মোরশেদ। ছবি: সংগৃহীত।
বাসচালক মোরশেদ। ছবি: সংগৃহীত।

মিডিয়াম ক্যাটাগরির যানবাহন চালানোর লাইসেন্স ছিল ট্রাস্ট সার্ভিসেস লিমিটেডের বাসচালক মোরশেদের (৩৫)। এই ক্যাটাগরির লাইসেন্সে সাত টনের নিচে যানবাহন চালাতে পারবেন তিনি। তবু দিব্যি হাতে তুলে নিয়েছিলেন ট্রাস্ট সার্ভিসেস লিমিটেডের বাসের স্টিয়ারিং।

ট্রাস্টের বাস চালানোর প্রথম দিনেই মোরশেদ চাপা দিলেন বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন করপোরেশনের (বিআইডব্লিউটিসি) কর্মকর্তা কৃষ্ণা রায় চৌধুরীকে। বাসের চাপায় পা হারাতে হয়েছে তাঁকে। বর্তমানে তিনি যন্ত্রণায় ছটফট করছেন রাজধানী ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে।

ট্রাস্টের বাসচালক মোরশেদকে গতকাল রোববার রাত সাড়ে ১০টার দিকে রাজধানীর মিরপুর এলাকার কাজীপাড়া থেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) ঢাকা মেট্রো উত্তরের একটি দল। পিবিআইয়ের পরিদর্শক মো. জুয়েল মিয়ার নেতৃত্বে দলটি বেশ কয়েক দিন ধরে দেশের বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালানোর পর মোরশেদকে গ্রেপ্তার করে। মোরশেদের কাছে ভারী যানবাহন চালানোর কোনো লাইসেন্স পায়নি পিবিআইয়ের দলটি।

যেভাবে গ্রেপ্তার হন মোরশেদ
গত ২৭ আগস্ট বেলা আড়াইটার সময় রাজধানীর বাংলামোটর এলাকায় ফুটপাতে দাঁড়িয়ে ছিলেন বিআইডব্লিউটিসির সহকারী ব্যবস্থাপক কৃষ্ণা রায় চৌধুরী। ওই সময় বেপরোয়া গতিতে ফার্মগেট থেকে বাস চালিয়ে আসছিলেন মোরশেদ। মোরশেদ ওই দিনই প্রথমবারের মতো বাসের স্টিয়ারিং হাতে নিয়ে রাজপথে নামেন। এর আগে তিনি প্রাইভেট কার চালাতেন। মিডিয়াম ক্যাটাগরির লাইসেন্সধারী মোরশেদ ট্রাস্ট পরিবহনের বাস নিয়ে বাংলামোটরে আসার পরপরই চাপা দেন কৃষ্ণাকে।

কৃষ্ণা রায়। ফাইল ছবি
কৃষ্ণা রায়। ফাইল ছবি

দুর্ঘটনার পর জটলার সৃষ্টি হলে মোরশেদ দ্রুত বাস থেকে নেমে যান। পালিয়ে প্রথমে যান রাজধানীর ইব্রাহিমপুর এলাকায়। সেখানেই তাঁর বাসা। তিন সন্তান ও স্ত্রী গ্রামের বাড়ি কিশোরগঞ্জ থাকায় তিনি পাঁচ দিন ধরে একাই ছিলেন। বাসায় গিয়ে দ্রুত ব্যাগ গুছিয়ে নেন। মোবাইলের সিম পরিবর্তন করে চলে যান কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জ উপজেলার বড় টিয়াপাড়া গ্রামে। পরদিন বিভিন্ন অনলাইন পত্রিকার মাধ্যমে জানতে পারেন, বাসচাপা দেওয়ার ঘটনায় তাঁকে আসামি করা হয়েছে। এরপর কৌশল বদলে ফেলেন মোরশেদ। গ্রামের বাড়িতে থাকলেও রাতের বেলা প্রতিবেশী কিংবা অন্য কারও বাড়িতে ঘুমাতেন তিনি। দিনের বেলা আসা-যাওয়ার মধ্যেই থাকতেন।

মোরশেদের অবস্থান নিশ্চিত হয়ে পরিদর্শক জুয়েল মিয়ার নেতৃত্বে পিবিআইয়ের দলটি গতকাল ভোরবেলা বড় টিয়াপাড়া গ্রামে পৌঁছায়। তবে তাদের উপস্থিতি টের পেয়ে চতুর মোরশেদ গা–ঢাকা দেওয়ার চেষ্টা করেন। বাড়ির ভেতরে শৌচাগারের পাশে একটি নারকেলগাছ ছিল। সেই নারকেলগাছ বেয়ে একেবারে মাথায় উঠে পড়েন তিনি। গাছের আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে ফেলেন। পিবিআইয়ের অভিযানকারীরা অনেকক্ষণ খোঁজাখুঁজির পরেও মোরশেদের নাগাল পাননি। বাধ্য হয়ে তাঁরা বড় টিয়াপাড়া গ্রাম ছেড়ে চলে যান।

অভিযানকারীরা চলে যাওয়ার পর মোরশেদ নারকেলগাছ থেকে নেমে আসেন। গ্রামের বাড়িতে না থেকে সোজা চলে আসেন রাজধানীতে। ঢাকার বিভিন্ন স্থানে ঘোরাঘুরির পর কাজীপাড়ায় আসেন গতকাল রাতের বেলা। আর রাতেই মোরশেদের অবস্থান নিশ্চিত করে কাজীপাড়া থেকে গ্রেপ্তার করা হয়।

পিবিআইয়ের পরিদর্শক জুয়েল মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, মোরশেদ মিডিয়াম ক্যাটাগরির লাইসেন্সধারী যানবাহনচালক। আগে তিনি বাসচালকের সহকারী ছিলেন। মিডিয়াম ক্যাটাগরির লাইসেন্স পেলেও বাস চালানোর অভিজ্ঞতা তাঁর ছিল না। এমন তথ্য মোরশেদ প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে পিবিআইকে দিয়েছেন।

জিজ্ঞাসাবাদে মোরশেদ পিবিআইকে বলেন, সহকারীর কাজ ছেড়ে তিনি ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় প্রাইভেট কার চালাতেন। এরপর গত ২৭ আগস্ট ট্রাস্ট পরিবহনের বাস চালানো শুরু করেন। প্রথম ট্রিপে ডিওএইচএস থেকে শাহবাগে বাস চালিয়ে আসছিলেন। এরপরই ঘটে যায় এই দুর্ঘটনা। মোরশেদের দাবি, তিনি যে বাসটি চালাচ্ছিলেন, তাতেই সমস্যা ছিল। আর এ কারণেই দুর্ঘটনাটি অনিচ্ছাকৃতভাবে ঘটে যায়।

ইচ্ছা কিংবা অনিচ্ছা—যেভাবেই দুর্ঘটনা ঘটুক না কেন, মিডিয়াম ক্যাটাগরির লাইসেন্স নিয়ে কোনোভাবেই কেউ ৪০ আসনের বাস চালাতে পারেন না বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) পরিচালক (অপারেশন) শীতাংশু শেখর বিশ্বাস। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, নিয়ম অনুযায়ী সাত টন ওজনের নিচে কোনো যানবাহন হলে সেটিকে মিডিয়াম ক্যাটাগরির যানবাহন বলা হয়। এই ধরনের যানবাহনের মধ্যে রয়েছে মিনিবাস, মাইক্রোবাস ইত্যাদি। এর ওপরের ওজনের যানবাহন হলে তার চালককে ভারী বা হেভি যানবাহনের লাইসেন্স নিতে হবে। যদি মিডিয়াম ক্যাটাগরির লাইসেন্স নিয়ে ভারী যান চালান, তাহলে ধরে নিতে হবে, ওই চালকের কোনো লাইসেন্স ছিল না।

কৃষ্ণা রায়ের কৃত্রিম পা বসানো হবে
ছয় দিন পেরিয়ে গেলেও কৃষ্ণা রায় চৌধুরীর বাঁ পায়ে এখনো যন্ত্রণা রয়েছে। গতকাল তাঁর হাঁটুর ওপরের আরও কিছু অংশ কেটে ফেলতে হয়েছে। কারণ, বাঁ পায়ের ক্ষতস্থান থেকে কিছু অংশ পচে যাচ্ছিল। এই পচন আরও ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কায় গতকাল মেডিকেল বোর্ড বসিয়ে অস্ত্রোপচারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। মেডিকেল বোর্ড তাঁর পায়ে অস্ত্রোপচারের পর কৃত্রিম পা বসানোর সিদ্ধান্ত নেয়। অস্ত্রোপচারে পায়ের কিছু মরা টিস্যু ফেলে দেওয়া হয়। এরপর স্কিন গ্রাফটিং করে বাঁ পা কৃত্রিম পা বসানোর উপযোগী করা হবে।

বিআইডব্লিউটিসির চিফ মেডিকেল অফিসার খোন্দকার মাসুম হাসান প্রথম আলোকে বলেন, হাঁটুর ওপরের কিছু অংশ ফেলে দেওয়ার পর কৃষ্ণা রায়ের পায়ে বারবার ড্রেসিং করাতে হবে। উপযুক্ত হলে কৃত্রিম পা স্থাপন করা হবে। তবে সেই কাজ দেশে না বিদেশে করানো হবে, সে সিদ্ধান্ত এখনো নেওয়া হয়নি।