রূপসাপাড়ে জাহাজ নির্মাণযজ্ঞ

জাহাজ নির্মাণ ও মেরামতের কাজ চলছে খুলনা শিপইয়ার্ডে। গত বৃহস্পতিবার। ছবি: রিয়াদুল করিম
জাহাজ নির্মাণ ও মেরামতের কাজ চলছে খুলনা শিপইয়ার্ডে। গত বৃহস্পতিবার। ছবি: রিয়াদুল করিম

রূপসা নদীর পাড়ে খুলনা শিপইয়ার্ডে চলছে জাহাজ নির্মাণের বিশাল কর্মযজ্ঞ। দেশের মাটিতে প্রথম যুদ্ধজাহাজ নির্মাণের পর এখন এখানে তৈরি করা হচ্ছে বাংলাদেশ নৌবাহিনী, কোস্টগার্ড ও পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষের জন্য বিভিন্ন ধরনের জাহাজ। একসময়কার রুগ্‌ণ প্রতিষ্ঠানটি ঘুরে দাঁড়িয়ে এখন লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে।

খুলনা শিপইয়ার্ডের যাত্রা শুরু ১৯৫৭ সালে। ক্রমাগত লোকসান ও দেনার দায়ে গত শতকের নব্বইয়ের দশকে এসে প্রতিষ্ঠানটি ডুবতে বসে। ২০ বছর আগে প্রতিষ্ঠানটিকে রুগ্‌ণ শিল্প ঘোষণা করে শিল্প মন্ত্রণালয় থেকে বেসরকারীকরণ কমিশনের কাছে হস্তান্তরের কাজ শুরু হয়েছিল। পরে তা না করে ১৯৯৯ সালের ৩ অক্টোবর সরকার খুলনা শিপইয়ার্ড পরিচালনার দায়িত্ব দেয় বাংলাদেশ নৌবাহিনীকে। এরপর থেকে পরিস্থিতি পাল্টাতে শুরু করে। এরপর একটু একটু করে প্রতিষ্ঠানটি ঘুরে দাঁড়াতে শুরু হয়। ২০০০-০১ অর্থবছরে এসে লাভ করতে শুরু করে। লাভ ৫০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায় ২০১৪-১৫ অর্থবছরে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে এসে প্রতিষ্ঠানটি লাভ করে ১৩৫ কোটি টাকা। খুলনা অঞ্চলে গত পাঁচ বছর টানা সর্বোচ্চ করদাতা হয়েছে বলে জানায় খুলনা শিপইয়ার্ড কর্তৃপক্ষ।

নৌবাহিনী দায়িত্ব নেওয়ার পর এই শিপইয়ার্ড দেশের মাটিতে প্রথমবারের মতো নির্মাণ করেছে যুদ্ধজাহাজ ও সাবমেরিন টাগ। তৈরি করেছে ৭৫ মিটার লম্বা কনটেইনার ভেসেল, প্রায় ৭৫ মিটার লম্বা কার্গো কাম কনটেইনার ভেসেল, ৬৮ মিটার লম্বা ১৫ হাজার টন ধারণক্ষমতার তেলবাহী জাহাজ, কে-টাইপ ফেরি, ফায়ার ফাইটিং বোট, প্যাট্রলবোটসহ বিভিন্ন ধরনের জাহাজ।

গত বৃহস্পতিবার শিপইয়ার্ডে গিয়ে দেখা যায় বিশাল কর্মযজ্ঞ। একদিকে জোড়া ও নানা আকৃতি দেওয়া হচ্ছে বড় বড় পাত। কোথাও চলছে সেগুলো জাহাজে লাগানোর কাজ। পাশে রাবার কারখানায় বানানো হচ্ছে জলযানের বিভিন্ন অংশ। আবার কোথাও বানানো হচ্ছে আসবাব। যে জাহাজগুলোর নির্মাণের কাজ শেষ পর্যায়ে, সেগুলো রাখা হয়েছে রূপসা নদীতে, জেটিতে।

শিপইয়ার্ড কর্তৃপক্ষ জানায়, এখন খুলনা শিপইয়ার্ডে বাংলাদেশ কোস্টগার্ডের জন্য ৫০ দশমিক ৪০ মিটার লম্বা ও ৭ দশমিক ৫০ মিটার চওড়া ইনশোর প্যাট্রল ভেসেল, ১৩ নটিক্যাল মাইল গতির এএসডি টাগবোট, ২৭ নটিক্যাল মাইল গতির হাইস্পিড বোট নির্মাণ করা হচ্ছে।

 বাংলাদেশ নেভির জন্য নির্মাণ করা হচ্ছে হাইড্রোগ্রাফিক সার্ভে ভেসেল, ল্যান্ডিং ক্রাফট ইউটিলিটি। পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষের জন্য পাইলট ভেসেল এবং হেভি ডিউটি স্পিডবোট নির্মাণের কাজ চলছে। এ ছাড়া ১৮টি বিভিন্ন ধরনের জাহাজ ও ফেরি নির্মাণ এবং ১১টি সামরিক ও ১৫টি বেসামরিক নৌযান মেরামতের কাজও চলছে।

চলমান প্রকল্পগুলোর মধ্যে চলতি বছর পাঁচটি জাহাজ নির্মাণের জন্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি সই করেছে খুলনা শিপইয়ার্ড। এরই মধ্যে ইলিশ নিয়ে গবেষণার জন্য মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের সঙ্গে একটি জাহাজ নির্মাণের চুক্তি হয়েছে। কোস্টগার্ডের জন্য হাইস্পিড ডাইভিং ও হাইস্পিড ফেরি বোট নির্মাণ, গোলাকৃতির ক্যাটামারান (বিশেষ ধরনের জাহাজ) এবং নৌবাহিনীর জন্য গোল ও চতুর্ভুজ আকৃতির ক্যাটামারান নির্মাণ করার চুক্তিও হয়েছে এ বছর।

খুলনা শিপইয়ার্ডেও নতুন সংযোজন রাবার কারখানা। গত জানুয়ারিতে উৎপাদন শুরু হয়েছে। এখানে জলযানের জন্য রাবারের বিভিন্ন যন্ত্রাংশ তৈরি করা হচ্ছে, যা আগে বিদেশ থেকে আমদানি করতে হতো।

খুলনা শিপইয়ার্ডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্যাপ্টেন মো. সাজেদুল করিম প্রথম আলোকে বলেন, নৌবাহিনীর কর্মকর্তাদের সততা, নিষ্ঠা ও সবার অক্লান্ত পরিশ্রমে শিপইয়ার্ড আজকের অবস্থানে এসেছে। তিনি বলেন, কেনাকাটায় স্বচ্ছতা ও উৎপাদনের মান নিশ্চিত করার পাশাপাশি শিপইয়ার্ডের আধুনিকায়ন করা হয়েছে। ভবিষ্যতে আরও আধুনিকায়ন হবে। অত্যাধুনিক ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড উইপন ওয়ার্কশপ করার পরিকল্পনা আছে। এ ছাড়া বরগুনার তালতলীতে সরকার ১৬২ একর জায়গা দিয়েছে, সেখানে ৩০ হাজার টনের জাহাজ নির্মাণের ক্ষমতাসম্পন্ন একটি শিপইয়ার্ড করা হবে। (শেষ)