সরাইলে বধ্যভূমিটি রক্ষায় সাইনবোর্ড

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল উপজেলার বধ্যভূমিটি সংরক্ষণের জন্য প্রশাসনের পক্ষ থেকে সাইনবোর্ড স্থাপন করা হয়। গত সোমবার বিকেলে।  প্রথম আলো
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল উপজেলার বধ্যভূমিটি সংরক্ষণের জন্য প্রশাসনের পক্ষ থেকে সাইনবোর্ড স্থাপন করা হয়। গত সোমবার বিকেলে। প্রথম আলো

অবশেষে প্রশাসনের হস্তক্ষেপে রক্ষা পেল ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল উপজেলার সেই বধ্যভূমি। এটি সংরক্ষণের জন্য গত সোমবার বিকেলে প্রশাসনের পক্ষ থেকে সাইনবোর্ড স্থাপন করা হয়েছে। বধ্যভূমিটি সরাইল-নাসিরনগর-লাখাই আঞ্চলিক মহাসড়কের পাশে সরাইল উপজেলার কালীকচ্ছ ইউনিয়নের ধর্মতীর্থ নৌঘাটে অবস্থিত। 

এই বধ্যভূমিতে একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদ ৪৬ জনের তালিকাযুক্ত একটি নামফলক ছিল। গত ১০ জুলাই সন্ধ্যায় দুর্বৃত্তরা নামফলকটি তুলে নিয়ে যায়। এ নিয়ে ১৯ জুলাই প্রথম আলোয় ‘বধ্যভূমি থেকে উধাও শহীদদের নামফলক’ শিরোনামে সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এরপর নড়েচড়ে বসে প্রশাসন। 

সোমবার সন্ধ্যার আগে প্রশাসনের পক্ষ থেকে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এ এস এম মোসা বধ্যভূমির ঠিক মাঝখানে একটি সাইনবোর্ড স্থাপন করেন। যাতে লেখা রয়েছে, ‘১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কর্তৃক পরিচালিত গণহত্যার স্মৃতিবিজড়িত স্থান। এ স্থানের পবিত্রতা রক্ষা করার জন্য অনুরোধ করা হলো।’

 বধ্যভূমিতে সাইনবোর্ড স্থাপনের সময় অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন উপজেলার কালীকচ্ছ গ্রামের বাসিন্দা সাবেক সাংসদ জিয়াউল হক মৃধা, উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কমান্ডার ইসমত আলী, ডেপুটি কমান্ডার আনোয়ার হোসেন, কালীকচ্ছ ইউনিয়ন শাখা কমান্ডার রমেশ চন্দ্র রায়, ডেপুটি কমান্ডার আবদুর রহিম প্রমুখ।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, চাকশার গ্রামের পাশে একসময় ধর্মতীর্থ নৌকাঘাট নামে একটি ঘাট ছিল। মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকে (১৮ অক্টোবর) শতাধিক নারী–পুরুষকে (অধিকাংশ সংখ্যালঘু) হত্যা করে পাকিস্তানের সেনারা। এটি ধর্মতীর্থ গণহত্যা নামে পরিচিত। স্থানটি ধর্মতীর্থ নৌঘাট বধ্যভূমি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।

তিন–চার বছর আগে সরকার সারা দেশের বধ্যভূমি চিহ্নিত করে তা সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয়। এরই অংশ হিসেবে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা ধর্মতীর্থ বধ্যভূমিটি চিহ্নিত করেন। ২০১৭ সালেম মার্চে তৎকালীন স্থানীয় সাংসদ জিয়াউল হক মৃধা শহীদদের স্মরণে বধ্যভূমিতে ৪৬ জনের নামের তালিকাযুক্ত ৪ ফুট প্রস্থ ও ১২ ফুট উচ্চতার ফলক স্থাপন করেন। কিন্তু কয়েক মাস পর ওই নামফলক থেকে শহীদদের নাম মুছে ফেলে দুর্বৃত্তরা। ধর্মতীর্থ বধ্যভূমিটি সংরক্ষণের লক্ষ্যে ৪ নভেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা প্রশাসক হায়ত-উদ দৌলা বধ্যভূমিটি পরিদর্শন করেন।

১৯৭১–এর ৬ অক্টোবর সরাইল থানা শান্তি কমিটির আহ্বায়ক মুসলিম লীগ নেতা আবদুল মন্নাফ ঠাকুর ও তাঁর দোসর পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তা (ক্যাপ্টেন) রহমান খানসহ কয়েকজন সেনাকে ধর্মতীর্থ এলাকায় মুক্তিযোদ্ধারা হত্যা করেন। এর কয়েক দিন পর ধর্মতীর্থ নৌকাঘাটে নাসিরনগর সদর ইউপি ও নাসিরনগর থানা শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান সৈয়দ সওয়াব মিয়া চৌধুরীসহ কয়েকজন পাকিস্তানি সেনাকে হত্যা করে অস্ত্রশস্ত্র কেড়ে নেন মুক্তিযোদ্ধারা। এর প্রতিশোধ নিতে পাকিস্তানি সেনারা স্থানীয় রাজাকারদের সহযোগিতায় ১৮ অক্টোবর ধর্মতীর্থ নৌকাঘাটে গণহত্যা চালায়।

অভিযোগ রয়েছে, বধ্যভূমিটি উপজেলা আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক কমিটির ১ নম্বর সদস্য ফরহাদ রহমান দখলের চেষ্টা চালান।

 উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, সরাইল উপজেলার কালীকচ্ছ ইউনিয়নের ধর্মতীর্থ বধ্যভূমির পেছনের ৩৪ শতাংশ ভূমির মালিক ছিলেন কালীকচ্ছ ইউনিয়নের চাকশার গ্রামের আবদুস সাত্তার ও তাঁর ভাতিজা আবদুল আহাদ। প্রায় ১০ বছর আগে ফরহাদ রহমান ৩৪ শতাংশ জমি কেনেন। এরপর তিনি ধীরে ধীরে খালের ওপর সরু কালভার্ড নির্মাণ করে নৌকাঘাটসহ প্রায় ৮০ শতাংশ ভূমি মাটি ভরাট করে দখলে নেন। ওই ভূমিতে এম আবদুল্লাহ ফরহাদ ফিলিং স্টেশন নামের একটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান করার লক্ষ্যে ১৮ জুন তাঁর ছেলে শাহ আবদুল্লাহ ফরহাদ জেলা প্রশাসকের কাছে অনাপত্তিপত্রের জন্য আবেদন করেন। জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে ৪ জুলাই ইউএনওকে তদন্ত করে প্রতিবেদন দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। 

উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের ডেপুটি কমান্ডার আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘যেখানে সাইনবোর্ড স্থাপন করা হয়েছে, তা ধর্মতীর্থ বধ্যভূমি হিসেবে চিহ্নিত। বধ্যভূমিটি রক্ষা করার জন্য আমরা প্রশাসনের কাছে অনুরোধ করে আসছিলাম।’

সাবেক সাংসদ জিয়াউল হক মৃধা বলেন, ‘যেসব ভূমিদস্যু বধ্যভূমি দখল করতে চেয়েছিল, তাদের বিচার হওয়া দরকার। আমরা এদের বিচার চাই।’

একাত্তরে যুদ্ধকালীন সরাইল থানা মুক্তিযোদ্ধা গ্রুপ কমান্ডার আবদুল্লাহ ভূঁইয়া বলেন, আবদুল মন্নাফ ঠাকুর ছিলেন ফরহাদ রহমানের আপন মামা। আবদুল মন্নাফ ঠাকুর নিহত হওয়ার পর শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন ফরহাদ রহমানের বাবা খন্দকার ফয়েজ আহমদ ওরফে সেলুর বাপ। ধর্মতীর্থের এই সেলুর বাপের নেতৃত্বেই গণহত্যা চালানো হয়। এই ইতিহাসকে মুছে ফেলার উদ্দেশ্যেই বধ্যভূমিটি নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টা চালাচ্ছেন ফরহাদ। 

 জানতে চাইলে ফরহাদ রহমান বলেন, ‘স্থানটি সরকারের পক্ষ থেকে বধ্যভূমি হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে কি না, জানি না। বধ্যভূমিসংশ্লিষ্ট প্রমাণাদি দেখাতে পারলে আমি বিষয়টি অবশ্যই আমলে নেব। এ ব্যাপারে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে আমার কথাও হয়েছে। বধ্যভূমি হয়ে থাকলে জায়গা ছেড়ে দিতে আমার কোনো আপত্তি নেই।’ 

ইউএনও এস এম মোসা বলেন, জেলা প্রশাসনের নির্দেশে এখানে সাইনবোর্ড স্থাপন করা হয়েছে। এই ভূমিতে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান করার জন্য যে অনাপত্তি সনদ দেওয়া হয়েছিল, তা বাতিলের প্রক্রিয়া চলছে। স্থানটি বধ্যভূমি হিসেবে সংরক্ষণের জন্যই প্রশাসনের পক্ষ থেকে সাইনবোর্ড স্থাপন করা হয়েছে।