আবুল হোসেনের গল্পটি প্রেরণার

নিজেদের ছোট্ট চায়ের দোকানে আবুল হোসেন। ছবি: লেখক
নিজেদের ছোট্ট চায়ের দোকানে আবুল হোসেন। ছবি: লেখক

সাধারণত মায়ের হাতের রান্না সব সময় সেরা। আনোয়ার হোসেনের কাছেও তা-ই। তবে ইলিশ মাছ হলে মায়ের চেয়ে মেজ ভাইয়ের হাতের রান্নাটাই বেশি অমৃত তাঁর কাছে। পাতে ভাইয়ের রান্না করা ইলিশ পড়লে আনন্দের সীমা থাকে না।

শুধু ইলিশ নয়, মেজ ভাই আবুল হোসেনের রান্না করা ডালও খুব পছন্দ ছোট ভাই আনোয়ারের। প্রতিদিন আর যা-ই হোক, পাতে ভাইয়ের রান্না করা ডাল চাই-ই। রান্নায় বিশেষ কোনো মসলা ব্যবহার না করলেও স্বাদের বিচারে তা অনন্য ছোট ভাইয়ের কাছে।

জন্মগতভাবেই বাক্ ও শ্রবণপ্রতিবন্ধী আবুল হোসেন। বাড়ি নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলার এনায়েতপুর গ্রামে। বড় ভাই মোশারফ হোসেন ও ছোট ভাই আনোয়ারের সঙ্গে থাকেন ঢাকার ভূতের গলিতে, মেসে। একটি কক্ষ নিয়ে তিন ভাইয়ের বসবাস। মা-বাবা থাকেন বাড়িতে।

বাবার ব্যবসার সূত্রে তিন ভাইয়েরই রাজধানীর বুকে পা রাখা। আজ থেকে ২০ বছর আগে বাবা লোকমান হোসেন ঢাকায় আসেন। ব্যস্ততম গ্রিন রোডে রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেপজা) সামনে ছোট্ট একটি দোকান নিয়ে শুরু করেন চায়ের ব্যবসা। অভাবের সংসারের চাকা সচল রাখতে বাবার সঙ্গে মাত্র আট বছর বয়সে ঢাকায় আসেন আবুল।

বছর পাঁচেক যেতে দোকান স্থানান্তর করেন লোকমান হোসেন। সামান্য দূরে সেন্ট্রাল হাসপাতালের দক্ষিণের ঠিক সামনে দোকান দেন তিনি। ফুটপাতের ওপর চায়ের অস্থায়ী দোকানটিই এখন পরিবারটির আয়ের উৎস। বয়সের কারণে পাঁচ বছর আগে বাবা চলে যান গ্রামে। দীর্ঘদিন ধরে বড় ছেলে মোশারফই দোকান দেখাশোনা করছেন। তাঁকে সহযোগিতা করছেন ছোট দুই ভাই। দোকানটি মোশারফ পরিচালনা করলেও চালাচ্ছেন মূলত আনোয়ার। তিনিই চা বানান। আদা চা, লেবু চা, মাল্টা চা, তেঁতুল চা—নানা সব চা বানাতে সিদ্ধহস্ত তিনি। তাঁর তৈরি রং চায়ের স্বাদই আলাদা। তেঁতুল চায়ের ভিন্নস্বাদও মন ভরে দেয়। টক, ঝাল আর মিষ্টির সমন্বয়ে এই চা একবার যেন না খেলেই নয়!

কারও অসুস্থতা বা পারিবারিক কোনো সমস্যা না থাকলে সাধারণত দোকান বন্ধ রাখা হয় না। প্রতিদিনই দোকান খোলা থাকে। সকাল ৭টার মধ্যে দোকান খোলে। চলে রাত ১১টা পর্যন্ত। বড় ও ছোট ভাই পালা করে দায়িত্ব পালন করেন। তাঁদের সঙ্গে থাকেন আবুল হোসেন। মাঝে দুপুর ১২টা থেকে বিকেল পর্যন্ত তিনি বাসায় থাকেন।

দোকানের মতো বাসাও আবুল হোসেনকে সমানে সামলাতে হয়। সকালে দোকান খোলার পর দুপুর পর্যন্ত সেখানে থাকেন। এরপর চলে যান বাসায়। তিন ভাইয়ের রান্নাবান্নার কাজ তিনিই করেন। খাওয়াদাওয়া শেষে একটু বিশ্রাম নিয়ে বিকেলে আবার চলে আসেন দোকানে।

পড়াশোনা না জানলেও মুঠোফোন ব্যবহারে পারঙ্গম আবুল হোসেন। কাজের ফাঁকে একটু অবসর পেলেই বড় ভাইয়ের স্মার্ট ফোন নিয়ে বসে পড়েন। ছবি দেখে ফেসবুকে বন্ধুদের ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠান। বন্ধুদের পোস্ট করা বিভিন্ন ছবি দেখে লাইক দেন। অ্যানালগ ফোনে কারও সঙ্গে কথা বলতে পারেন না। তবে স্মার্টফোনে কাছের লোকজনের সঙ্গে ভিডিও কলে আকার-ইঙ্গিতে কথা বলেন।

২০১৬ সালে বিয়ে করেছেন আবুল হোসেন। দেড় বছরের একটি ছেলে আছে। নাম আদনান। ছেলেটি সুস্থ-স্বাভাবিক। কথা বলতে শিখেছে। স্ত্রী ও সন্তান বাড়িতেই থাকে। মাসে এক-দুবার গ্রামে যান আবুল। সবশেষ গেছেন ঈদুল আজহায়। এলাকায় প্রচুর বন্ধু। মিশুক বলে সবার সঙ্গে তাঁর ভালো সম্পর্ক।

পাশের দোকানি ওমর ফারুক। প্রায় ১৫ বছর ধরেই চেনেন আবুল হোসেনকে। বললেন, ‘ও (আবুল হোসেন) খুব শক্তিশালী। একাই আট-দশজনকে সামলাতে পারে। তবে কারও সঙ্গে ওর ঝামেলা নেই। দীর্ঘদিন ধরে যাঁরা এখানে আসেন, তাঁরা সবাই ওর সম্পর্কে জানেন। আর যাঁরা নতুন, তাঁদের বুঝিয়ে বলে ওর দুই ভাই। ফলে কখনো কারও সঙ্গে আবুলের ঝামেলা বাধে না।’

ওমর ফারুকের ভাষায়, প্রতিবন্ধী আবুল হোসেনের একটি বিশেষ গুণ হচ্ছে অনুকরণ-শক্তি। একবার যা দেখেন, তা হুবহু করতে পারেন। আরেকটি গুণ হচ্ছে প্রচণ্ড ধৈর্যশক্তি।

কথা বলতে বলতে আবুল হোসেনের বানানো রং চায়ের স্বাদ নিচ্ছি, আর ভাবছি—এই ব্যস্ত শহরে এভাবেই লুকিয়ে আছে কত টুকরো টুকরো গল্প। কোনো গল্প কাউকে কাঁদায়, কোনোটি হাসির রসদ জোগায়। আর আবুল হোসেনদের গল্প জোগায় প্রেরণা।