জাতীয় পার্টির সঙ্গে আ. লীগকেও মাঠে চাইছে বিএনপি

রংপুর যে কেবল এরশাদ ও তাঁর লাঙ্গল প্রতীকের ঘাঁটি—সদর আসনের উপনির্বাচনে এ ধারণা পাল্টে দিতে চায় বিএনপি। এ জন্য বিএনপির রংপুরের নেতারা চাইছেন এই উপনির্বাচনে জাতীয় পার্টির (জাপা) পাশাপাশি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগও প্রার্থী দিয়ে মাঠে থাকুক।

গত তিন দিন রংপুর জেলা ও মহানগর বিএনপি এবং এর অঙ্গসংগঠনের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে তাঁদের এই মনোভাব জানা গেছে। তবে বিএনপির নেতারা এ–ও বলছেন, নির্বাচন কতটা সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হবে এবং গত ৩০ ডিসেম্বরের মতো ভোট গ্রহণে কোনো কারসাজি হয় কি না; এ নিয়ে তাঁরা শঙ্কার মধ্যে আছেন। এই শঙ্কা দূর করা গেলে এরশাদোত্তর রংপুরের ভোটের প্রকৃত চিত্র ফুটে উঠবে বলে মনে করছেন বিএনপির নেতারা।

তবে বিএনপির রংপুর অঞ্চলের মধ্যম ও নিচের সারির নেতাদের অনেকে বলছেন, রংপুর-৩ সংসদীয় আসনের উপনির্বাচনে বিএনপির জুতসই প্রার্থী নেই। যে দুই-তিনজনের নাম আলোচনার শীর্ষে, তাঁদের একজনের নিজের দল আছে। তিনি বিএনপি জোটের শরিক দল পিপলস পার্টি অব বাংলাদেশের চেয়ারম্যান রিটা রহমান। তাঁর বড় পরিচয় তিনি প্রয়াত রাজনীতিক মসিয়ুর রহমান যাদু মিয়ার মেয়ে। গত সংসদ নির্বাচনেও তিনি এরশাদের বিপরীতে ধানের শীষ প্রতীকের প্রার্থী হয়ে ৫৩ হাজার ভোট পেয়েছিলেন।

দলীয়ভাবে যাঁর কথা বেশি আলোচনায় ছিল তিনি হলেন মহানগর বিএনপির সভাপতি ও মুক্তিযোদ্ধা মোজাফফর হোসেন। তিনি ১ সেপ্টেম্বর মারা গেছেন। তাঁর জানাজায় ব্যাপক মানুষের উপস্থিতি ছিল। এখন মোজাফফর হোসেনের স্ত্রী সুফিয়া হোসেনও মনোনয়ন চাচ্ছেন।

এর বাইরে জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক রইচ আহমেদ, মহানগর কমিটির সহসভাপতি কাওছার জামান ও সাধারণ সম্পাদক শহিদুল ইসলাম মনোনয়নপ্রত্যাশী। এই তিনজনের বিরুদ্ধে অর্ধশত মামলা আছে। তাঁদের মধ্যে রইচ আহমেদ ও শহিদুল ইসলাম আগে কখনো নির্বাচন করেননি। কাওছার জামান রংপুর সিটি করপোরেশনের সর্বশেষ নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী হয়ে ৩৭ হাজার ভোট পেয়েছিলেন।

রইচ আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘জাতীয় পার্টি ও আওয়ামী লীগ ক্ষমতার ভাগাভাগিতে আছে। রংপুরে নির্বাচন যদি একটু পরিচ্ছন্ন হয়, তাহলে আমাদের সঙ্গে লড়াই করেই আসতে হবে। না হয় কৌশল খাটিয়েই নিতে হবে।’

এরশাদের দল জাতীয় পার্টির প্রার্থী এস এম ইয়াসিরের নাম প্রায় চূড়ান্ত, আনুষ্ঠানিক ঘোষণার বাকি। তিনি রংপুর মহানগর জাপার সাধারণ সম্পাদক। দলীয় নেতা-কর্মী ও সমর্থকদের মধ্যে তাঁর একটা অবস্থান গড়ে উঠেছে। তা ছাড়া এই মুহূর্তে রংপুরে জাতীয় পার্টির বড় খুঁটি মেয়র মোস্তাফিজার রহমানও ইয়াসিরের সঙ্গে আছেন।

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগে মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন ১৬ জন। তাঁদের মধ্যে কেন্দ্রীয়ভাবে দুজনের নাম আলোচনায় বেশি এসেছিল। তাঁরা হলেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য চৌধুরী খালেকুজ্জামান ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক রেজাউল করিম। রেজাউল রংপুরের বিশিষ্ট আইনজীবী। আর খালেকুজ্জামান বর্ষীয়ান আমলা, যাঁকে পরপর তিনবার এ আসনে আওয়ামী লীগ মনোনয়ন দিয়েছিল। পরে মহাজোটের শরিক জাতীয় পার্টির সঙ্গে সমঝোতার কারণে তাঁর নির্বাচন করা হয়নি। তবে গতকাল রাতে গণভবনে আওয়ামী লীগের সংসদীয় মনোনয়ন বোর্ডের সভায় রেজাউল করিমকে প্রার্থী ঠিক করা হয়েছে।

তবে বিএনপির স্থানীয় নেতারা মনে করছেন, যদি আওয়ামী লীগের সঙ্গে জাতীয় পার্টির প্রকাশ্য বা অপ্রকাশ্যে কোনো সমঝোতা না হয়, তাহলে আসন্ন ৫ অক্টোবরের উপনির্বাচনে ত্রিমুখী প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে। তাঁরা বলছেন, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এই আসনে ইভিএমে (ইলেট্রনিক ভোটিং মেশিন) ভোট গ্রহণ হলেও তাতে ব্যাপক কারচুপি হয়েছে। তারপরও সেই ভোটে এরশাদ প্রায় ১ লাখ ৪৩ হাজার ভোট পান। তাঁর সঙ্গে ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী রিটা রহমান ৫৩ হাজার ভোট পেয়েছিলেন। যা নিকট অতীতে এ আসনে বিএনপির সর্বোচ্চ ফলাফল। এখন এরশাদ আর নেই। এই অবস্থায় আসন্ন উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও জাপার সমঝোতা না হলে বিএনপির ভালো করার সুযোগ আছে বলে দলটির নেতারা মনে করেন।

যদিও বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশী শহিদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘এখন আর ভোট নয়, জয়-পরাজয় সরকারের ইচ্ছার ওপর নিভর করে।’ আর আওয়ামী লীগের রংপুর জেলা কমিটির কোষাধ্যক্ষ আবুল কাশেম মনে করেন, রংপুরে জাপাকে বারবার ছাড় দিতে গেলে অপশক্তির উত্থান ঘটতে পারে। অপশক্তি বলতে তিনি বিএনপিকে ইঙ্গিত করেছেন।

বিএনপির রংপুরের নেতা-কর্মীদের অনেকেই মনে করছেন, আড়ালে জাপা ও আওয়ামী লীগের মধ্যে সমঝোতার চেষ্টা চলছে। গতকাল রাতে জাপার মহাসচিব মসিউর রহমান গণভবনে গিয়েছিলেন বলেও জানতে পেরেছেন বিএনপির নেতারা। তাই এই নির্বাচনে বিএনপিকে হয়তো দুই দলকেই যুগপৎ মোকাবিলা করতে হবে বলে মনে করছেন তাঁরা। এই মুহূর্তে বিএনপির নেতাদের বড় শঙ্কা নির্বাচন মাঠে গড়ানোর পর পরিস্থিতি কী হয়। রংপুরে দেড় শ মামলায় আসামির তালিকায় থাকা প্রায় দেড় হাজার নেতা-কর্মীর ভাগ্যে শেষ পর্যন্ত কী ঘটে।

এ বিষয়ে জাতীয়তাবাদী যুবদলের রংপুর মহানগর কমিটির সভাপতি ও আইনজীবী মাহফুজ-উন–নবী প্রথম আলোকে বলেন, ‘এখন বিএনপির প্রতিপক্ষ তো আওয়ামী লীগ নয়, রাষ্ট্রযন্ত্র। মামলার বাদী হয় পুলিশ আর জামিনের আবেদন বাতিল করেন ম্যাজিস্ট্রেট।’