হোসেনি দালানে হামলা: ৪৬ জনের মধ্যে সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ মাত্র ১১ জনের

রক্তস্নাত স্থান। ফাইল ছবি
রক্তস্নাত স্থান। ফাইল ছবি

প্রায় চার বছর আগে আশুরা উপলক্ষে রাজধানীর হোসেনি দালানের শোক মিছিলে জঙ্গি হামলা মামলার বিচার সাক্ষ্য গ্রহণ পর্যায়ে আছে। বিচার শুরু হওয়ার দুই বছর তিন মাসের মাথায় ৪৬ জনের মধ্যে ১১ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হয়েছে।

রাষ্ট্রপক্ষ বলছে, অভিযোগপত্রভুক্ত ১০ জন আসামির মধ্যে ১ জন আসামি শিশু হিসেবে গণ্য হওয়ায় মামলার সাক্ষ্য গ্রহণ কার্যক্রমে কিছুটা ভাটা পড়ে। তবে এখন থেকে যত দ্রুত সম্ভব সাক্ষীদের আদালতে হাজির করা হবে।

আসামিপক্ষ বলছে, একজন আসামি শিশু হলেও পুলিশ সাবালক হিসেবে অভিযোগপত্র দেয়। বিষয়টি আদালতের নজরে আনার পর ওই আসামিকে শিশু হিসেবে গণ্য করেন আদালত।

মামলার সংক্ষিপ্ত বিবরণ অনুসারে, প্রায় চার বছর আগে ২০১৫ সালের ২৪ অক্টোবর আশুরা উপলক্ষে হোসেনি দালানের শোক মিছিলে গ্রেনেড হামলা চালায় জঙ্গিরা। এ ঘটনায় একজন নিহত ও শতাধিক ব্যক্তি আহত হয়। পরে পুলিশ চকবাজার থানায় পরের দিন মামলা করে। তদন্ত শেষে পরের বছর ২০১৬ সালের ২১ এপ্রিল ১০ জন জঙ্গির বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। তাতে বলা হয়, জননিরাপত্তা বিঘ্নিত করার জন্যই সন্ত্রাসী জঙ্গিগোষ্ঠী তাদের পরিকল্পনা ও ধারাবাহিক ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে এই হামলা চালায়।

হোসেনি দালানে জঙ্গি হামলার এই মামলায় পুলিশের দেওয়া অভিযোগপত্র আমলে নিয়ে ২০১৭ সালের ৩১ মে ১০ জন জঙ্গির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালত। পরে মামলাটি বিচারের জন্য ঢাকার অষ্টম অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতে পাঠানো হয়। পরে মামলাটি গত বছরের ১৪ মে ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালে পাঠানো হয়।

ঘটনাস্থলে পড়ে আছে বিস্ফোরক বস্তু। ফাইল ছবি
ঘটনাস্থলে পড়ে আছে বিস্ফোরক বস্তু। ফাইল ছবি

এই ট্রাইব্যুনালের সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, বিভিন্ন আদালত ঘুরে গত বছর এই মামলাটি তাঁদের ট্রাইব্যুনালে আসে। এরপর রাষ্ট্রপক্ষ থেকে সাক্ষীদের আদালতে হাজির করা হয়। এই মামলার ৪৬ জন সাক্ষীর মধ্যে ১১ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হয়েছে। অভিযোগপত্রভুক্ত ১০ জন আসামির মধ্যে ১ জনের পক্ষে আদালতে দাবি করা হয়, ওই আসামি নাবালক। এর সপক্ষে জন্মসনদ, পরীক্ষার সনদ জমা দেয়। আদালত সব কাগজপত্র পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে ওই আসামিকে শিশু হিসেবে আখ্যায়িত করেন। আইন অনুযায়ী, ওই আসামিকে শিশু হিসেবে আখ্যায়িত করে সম্পূরক অভিযোগপত্র দিতে বলেন। পুলিশ আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী সম্পূরক অভিযোগপত্র জমা দিয়েছেন। ওই শিশুর মামলাটি শিশু আদালতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।

পিপি জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী আরও বলেন, আগামীকাল ৯ সেপ্টেম্বর এই মামলার সাক্ষ্য গ্রহণের শুনানির দিন ধার্য রয়েছে। রাষ্ট্রপক্ষ থেকে সাক্ষীদের আদালতে হাজির করা হবে। যত দ্রুত সম্ভব নৃশংস এই জঙ্গি হামলার মামলায় রাষ্ট্রপক্ষ থেকে বাকি সব সাক্ষীকে হাজির করা হবে।

এ হামলার মামলায় অভিযোগপত্রভুক্ত ১০ আসামি হলেন মাসুদ রানা ওরফে সুমন, কবীর হোসেন ওরফে রাশেদ ওরফে আসিফ, আবু সাঈদ ওরফে সালমান, আরমান ওরফে মনির, রুবেল ইসলাম ওরফে সুমন ওরফে সজীব, চান মিয়া, ওমর ফারুক, হাফেজ আহসানউল্লাহ মাহমুদ, শাহজালাল ও একজন কিশোর আসামি। এদের মধ্যে চারজন জামিনে আছেন। বাকিরা কারাগারে।

রাষ্ট্রপক্ষ বলছে, হোসেনি দালানে যারা হামলা চালায়, তারা সবাই জেএমবির সক্রিয় সদস্য। এই হামলায় আরও তিনজনের নাম পাওয়া গেলেও তারা বিভিন্ন সময় বন্দুকযুদ্ধে মারা গেছে। ওই তিনজন হলো হিরন ওরফে কামাল, আলবানি ওরফে হোজ্জা ও আবদুল্লাহ ওরফে আলাউদ্দিন।
আসামিপক্ষে মামলা পরিচালনা করছেন আইনজীবী ফারুখ আহম্মেদ।

পুরান ঢাকার হোসেনি দালান এলাকায় গভীর রাতে বোমা হামলায় আহত ব্যক্তিদের একজন। ফাইল ছবি
পুরান ঢাকার হোসেনি দালান এলাকায় গভীর রাতে বোমা হামলায় আহত ব্যক্তিদের একজন। ফাইল ছবি

সেদিন যা ঘটেছিল
পুলিশ, প্রত্যক্ষদর্শী ও আহত ব্যক্তিরা জানান, হোসেনি দালানে সেদিন রাত পৌনে দুইটার দিকে এ হামলার ঘটনা ঘটে। নিরাপত্তার জন্য পোশাকধারী পুলিশের পাশাপাশি সাদাপোশাকে নিরাপত্তা সংস্থার সদস্যরা এ সময় ওই এলাকায় মোতায়েন ছিলেন। জঙ্গি হামলায় নিহত কিশোরের নাম সাজ্জাদ হোসেন। হাসপাতালে আনার আগেই তার মৃত্যু হয়।

পবিত্র আশুরা উপলক্ষে তাজিয়া মিছিলে অংশ নিতে পুরান ঢাকার হোসেনি দালানে আসে নগরীর বিভিন্ন এলাকার মানুষ। তাদের অধিকাংশই শিয়া সম্প্রদায়ভুক্ত। হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর দৌহিত্র হজরত ইমাম হোসাইনের (রা.) শহীদ হওয়ার দিনকে শিয়া সম্প্রদায়ের মানুষেরা ত্যাগ ও শোকের প্রতীক হিসেবে পালন করে থাকে।

পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, হোসেনি দালানের মূল ফটকে একটি তাজিয়া মিছিলের প্রস্তুতি চলছিল। মিছিলটি পল্টনে যাওয়ার কথা ছিল। মিছিলে যোগ দিতে এসেছিলেন তরুণ, বৃদ্ধ, নারী ও শিশুরা। এর মধ্যেই রাত পৌনে দুইটার দিকে মুহুর্মুহু বিস্ফোরণের শব্দে কেঁপে ওঠে পুরো এলাকা। কারও কারও মতে, পরপর ১০-১৫টি বিস্ফোরণের শব্দ শুনেছেন। বিস্ফোরণের সঙ্গে সঙ্গে অনেকে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। কেউবা দৌড় দিতে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পায়ের তলায় পড়েছেন। কান্না-চিৎকারে ভারী হয়ে ওঠে পুরো এলাকা। আশপাশের বাসিন্দারা যে যেভাবে পারেন মোটরসাইকেল, অটোরিকশা, ভ্যান, লেগুনায় করে আহত ব্যক্তিদের ঢাকা মেডিকেল, মিটফোর্ড হাসপাতাল ও আশপাশের বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যান। ঘটনার পরে হোসেনি দালান এলাকায় অনেককে পড়ে থাকতে দেখা যায়।

ঘটনাস্থলে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে ছিল ভাঙা চেয়ার, স্যান্ডেল, তাজিয়া মিছিলের সরঞ্জামাদি। বিভিন্ন স্থানে ছিল ছোপ ছোপ রক্ত। ঘটনাস্থলে কালো স্কচটেপ মোড়ানো একাধিক অবিস্ফোরিত বোমা পড়ে ছিল।