সবাই ফিরে গেলেন শৈশবে

‘আইপিডিসি-প্রথম আলো প্রিয় শিক্ষক সম্মাননা’ অনুষ্ঠানে শিক্ষকদের সঙ্গে আয়োজক ও অতিথিরা। গতকাল যশোরের সিসিটিএস মিলনায়তনে।  প্রথম আলো
‘আইপিডিসি-প্রথম আলো প্রিয় শিক্ষক সম্মাননা’ অনুষ্ঠানে শিক্ষকদের সঙ্গে আয়োজক ও অতিথিরা। গতকাল যশোরের সিসিটিএস মিলনায়তনে। প্রথম আলো

মঞ্চে দাঁড়িয়ে শৈশবের প্রিয় শিক্ষকের গল্প বলছিলেন অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মুস্তাফিজুর রহমান। গল্পের প্রিয় শিক্ষক তারাপদ দাস সামনের আসনে বসে তন্ময় হয়ে শুনছিলেন প্রিয় ছাত্রের বক্তব্য। তারাপদ স্যার আমার অনুপ্রেরণা। তাঁর জন্য আমি আজ মুস্তাফিজুর রহমান। তিনি (তারাপদ) বলতেন, ‘মুস্তাফিজ আমার বড় ছেলে। সত্যিই আমি তাঁর বড় ছেলে।’ মঞ্চ থেকে নিচে নেমে আসতেই প্রিয় ছাত্র মুস্তাফিজুর রহমানকে জড়িয়ে ধরলেন তারাপদ দাস। মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করলেন।

এরপর মঞ্চে ডাক পড়ল তারাপদ দাসের। তিনি বললেন, ‘মুস্তাফিজ আমার বড় ছেলে। আমার ছাত্ররা দেশকে ভালোবাসে। ভালোবাসে দেশের মানুষকে। মানুষের সেবা করলে ঈশ্বরের সেবা করা হয়।’

গতকাল শনিবার বিকেলে যশোর সিসিটিএস (খ্রিষ্টান চার্চ ট্রেড স্কুল) মিলনায়তনে ‘আইপিডিসি-প্রথম আলো প্রিয় শিক্ষক সম্মাননা-২০১৯’ উপলক্ষে সুধী সমাবেশ হয়। এতে উপস্থিত আমন্ত্রিত শিক্ষক, ব্যবসায়ী, পেশাজীবীসহ অন্যরা বক্তব্য দেন। নিজের শৈশবের প্রিয় শিক্ষকদের কথা স্মরণ করতে গিয়ে অনেকে এ সময় আপ্লুত হয়ে পড়েন। সবাই ফিরে যান শৈশবে।

যশোর সরকারি মাইকেল মধুসূদন কলেজের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক আর এম এ জাকারিয়া বলেন, ‘শিক্ষকেরা শুধু শিক্ষকই নন, তাঁরা দার্শনিক, বাতিঘর, গাইড ও রোল মডেল। শৈশবে একবার ক্লাস ফাঁকি দিয়ে সিনেমা দেখতে গিয়েছিলাম। সিনেমা শুরুর আগে হঠাৎ সিনেমা হলের দরজা খুলে গেল। দেখি হাবিবুর রহমান স্যার দরজায় দাঁড়িয়ে আছেন। এরপর স্যার আমাকে বেদম বেত্রাঘাত করলেন। সেদিনের কথা আজও ভুলতে পারিনি। সেদিন মার খেয়েছিলাম বলে আমি আজ কিছুটা হলেও শিক্ষক হতে পেরেছি।’

বেগমপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক স্বপন কুমার মণ্ডল বলেন, ‘শৈশবে দীন মোহাম্মদ স্যারের শাসন-আদর পেয়েছিলাম বলে আজ শিক্ষক হতে পেরেছি। স্যার বলতেন, “সিনেমা দেখতে চাইলে আমার কাছ থেকে টাকা নেবে। আর লেখাপড়া করতে চাইলে প্রতিদিন সকালে আমার বাড়িতে পড়তে আসবে।” আমি স্যারের বাড়িতে রোজ সকালে পড়তে যেতাম। পরে স্যারের সঙ্গে একই বিদ্যালয়ে ছয় বছর চাকরি করেছি। স্যার ছিলেন প্রধান শিক্ষক আর আমি সহকারী প্রধান শিক্ষক। স্যার আমার কাজগুলো করে দিতেন। ভাবতেন, আমি তখনো ছোট রয়েছি।’

নির্ধারিত নিয়মে মনোনয়ন শেষে প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের ৫ জন করে ১০ জন শিক্ষককে দেওয়া হবে ‘আইপিডিসি-প্রথম আলো প্রিয় শিক্ষক সম্মাননা’। এর অংশ হিসেবে গতকাল আইপিডিসি ও প্রথম আলোর উদ্যোগে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। আগামী ৪ অক্টোবর নির্বাচিত প্রিয় শিক্ষকদের আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মাননা দেওয়া হবে।

‘আইপিডিসি-প্রথম আলো প্রিয় শিক্ষক সম্মাননা’ সুধী সমাবেশ অনুষ্ঠানে শিক্ষক ও অতিথিরা। গতকাল যশোরের সিসিটিএস মিলনায়তনে।  প্রথম আলো
‘আইপিডিসি-প্রথম আলো প্রিয় শিক্ষক সম্মাননা’ সুধী সমাবেশ অনুষ্ঠানে শিক্ষক ও অতিথিরা। গতকাল যশোরের সিসিটিএস মিলনায়তনে। প্রথম আলো

রাষ্ট্রের বাণিজ্যিক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি (সিআইপি) হিমায়িত চিংড়ি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান এমইউসি ফুডস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শ্যামল দাস বলেন, ‘আমার প্রিয় শিক্ষক ছিলেন জহুরুল হক। ছোটবেলায় একটি ক্লাস ফাঁকি দেওয়ার জন্য তিনি আমাকে বেত দিয়ে প্রচণ্ড মেরেছিলেন। আজ বুঝি, স্যারের প্রতিটি বেত্রাঘাত ছিল আমার অনুপ্রেরণা।’

নারী উদ্যোক্তা পারভিন আকতার বলেন, ‘নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় আমার বিয়ে হয়ে যায়। তখন আমার প্রিয় শিক্ষক ব্রজেন স্যার আমাদের বাড়িতে গিয়ে খুব দুঃখ প্রকাশ করেন।

এ সময় তিনি (ব্রজেন স্যার) বলেছিলেন, মেধাবী মেয়েটার বিয়ে দিয়ে দিলেন? তখন স্যার আমাকে উদ্দীপনামূলক অনেক প্রেরণা দেন। স্যারের সেই অনুপ্রেরণায় আজ আমি এত দূরে এসেছি। শ্রেষ্ঠ নারী উদ্যোক্তা হিসেবে দুবার জাতীয় পুরস্কার পেয়েছি।’

পারভিন আকতার আরও বলেন, ‘আমার বুটিক কারখানায় এখন ৫২ জন নারী কাজ করেন। এ ছাড়া আরও ৩০০ জন পরোক্ষভাবে আমার কারখানার কাজের সঙ্গে জড়িত।’

আইপিডিসি ফাইন্যান্সের যশোর শাখার ব্যবস্থাপক জসীম উদ্দীন বলেন, ‘শৈশবের দিনগুলোতে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে স্যার ছিলেন আমার অনুপ্রেরণার উৎস। মহান ওই শিক্ষকদের অনুপ্রেরণা ছাড়া শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ গঠিত হয় না। সেই শিক্ষকদের সম্মাননা জানাতে পারাটা আমাদের জন্য অনেক আনন্দের; গর্বের।’

অনুষ্ঠানের শুরুতেই বক্তব্য দেন প্রথম আলোর হেড অব ইভেন্ট অ্যান্ড অ্যাক্টিভেশন কবির বকুল। তিনি বলেন, প্রথম আলো বিভিন্ন সামাজিক কাজ, শিক্ষামূলক কাজসহ মাদকবিরোধী এবং শিক্ষার্থী ও তরুণদের নিয়ে কাজ করে। তবে শিক্ষকদের সম্মাননা বিষয়ে এটা প্রথম আলোর প্রথম কাজ।

অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর যশোর প্রতিনিধি মনিরুল ইসলাম। এরপর প্রথম আলো ট্রাস্টের উদ্যোগে গড়া পদ্মাপারের আলোর পাঠশালা নিয়ে তৈরি একটি প্রামাণ্যচিত্র দেখানো হয়। সার্বিক সহযোগিতায় ছিলেন প্রথম আলো যশোর বন্ধুসভার সদস্যরা।

এরপর আইপিডিসির ‘উচ্ছ্বাস’ শীর্ষক প্রামাণ্যচিত্র এবং শিক্ষক সম্মাননা নিয়ে আরেকটি প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শিত হয়।