ভারত ছাড়া বিআরআইয়ের সাফল্য নিয়ে প্রশ্ন

চীনের ‘অঞ্চল ও পথের উদ্যোগ’ (বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ—বিআরআই) বাংলাদেশের জন্য ব্যাপক সম্ভাবনা তৈরি করেছে। কিন্তু প্রতিবেশী ভারত এতে যুক্ত না হওয়ায় চীনের বৃহৎ এই প্রকল্পের অংশীদার হয়েও বাংলাদেশের সুফল পাওয়া নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। ভারত ও চীনের সঙ্গে যথেষ্ট ভালো সম্পর্ক থাকার পরও রোহিঙ্গা সংকটে প্রত্যাশা অনুযায়ী তাদের পাশে পাওয়া যায়নি। এই অভিজ্ঞতা থেকে বাংলাদেশকে ভবিষ্যতে আরও বাস্তববাদী হতে হবে। একই সঙ্গে দুই দেশের সঙ্গে ভারসাম্যমূলক সম্পর্ক রেখে চলতে হবে।

চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) নিয়ে রোববার রাজধানীতে আয়োজিত আন্তর্জাতিক এক সম্মেলনে বিশিষ্টজনদের আলোচনায় এসব বিষয় উঠে এসেছে। গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) এই সম্মেলনের আয়োজন করেছে।

২০১৬ সালের অক্টোবরে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের ঢাকা সফরের সময় বিআরআইতে যুক্ত হয়েছে বাংলাদেশ। বিআরআই হচ্ছে অবকাঠামো উন্নয়ন ও বিনিয়োগের জন্য চীন সরকারের বৈশ্বিক উন্নয়নকৌশল। যেখানে এশিয়া, ইউরোপ, আফ্রিকা ও আমেরিকার ১৫২টি দেশ ও সংস্থা যুক্ত। চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং ২০১৩ সালে ইন্দোনেশিয়া ও কাজাখাস্তান সফরের সময় বিআরআইয়ের ঘোষণা দেন।

সম্মেলনের একটি অধিবেশনে ‘বিআরআইয়ের রাজনীতি’ শীর্ষক আলোচনায় সিপিডির চেয়ারম্যান অধ্যাপক রেহমান সোবহান বলেন, যেদিন ভারত ও চীন একসঙ্গে এগিয়ে আসবে, একমাত্র তখনই দুই দেশ বিশ্বে নতুন অর্থনৈতিক ও কৌশলগত ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করতে পারবে। এভাবেই আগামী শতাব্দীতে চীন–ভারতকেন্দ্রিক এশিয়ান জনগোষ্ঠীর আবির্ভাব ঘটবে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে।

প্যানেল আলোচক গবেষণাপ্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের (বিআইপিএসএস) প্রেসিডেন্ট মেজর জেনারেল (অব.) আ ন ম মুনীরুজ্জামান বলেন, বিআরআই বিশাল এক পরিকল্পনা, যাকে আক্ষরিক অর্থেই এ শতকের বৃহদায়তনের প্রকল্প বলা যেতে পারে। এটি একটি কৌশল নয়, একটি ব্যাপকতর কৌশল। এ ধরনের বৃহদায়তন প্রকল্পের অনিবার্যভাবেই গভীর রাজনৈতিক ও কৌশলগত দিক রয়েছে। তবে এটি বাণিজ্য, অবকাঠামো ও অর্থনৈতিক উদ্যোগ হলেও খুব সংগত কারণেই এর রাজনৈতিক ও কৌশলগত উপাদান রয়েছে।

আ ন ম মুনীরুজ্জামানের মতে, ভারত এই উদ্যোগে আগ্রহী হয়ে যোগ না দেওয়া পর্যন্ত এর বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কিছু সমস্যা দেখা দেবে। এতে মোট ছয়টি করিডর (সড়ক ও সমুদ্রপথে সংযোগ) আছে। এর মধ্যে চারটি সড়কপথের, দুটি সমুদ্রপথের। এই দুই করিডরের একটি হচ্ছে বিসিআইএম (বাংলাদেশ, চীন, ভারত ও মিয়ানমার)। এটি এখন আর বিআরআইতে নেই। চীন এখন মিয়ানমারের সঙ্গে সিএমইসি (চীন-মিয়ানমার অর্থনৈতিক করিডর) সই করেছে, যা বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত সমস্যার। বিসিআইএম কার্যকর না হওয়া বা ভারতের অসহযোগিতা—এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজা উচিত বাংলাদেশের।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক লাইলুফার ইয়াসমীন বলেন, ‘অর্থনীতির সঙ্গে নিরাপত্তাকে যুক্ত করছে চীন। ভারত আমাদের বৃহৎ প্রতিবেশী, তা ছাড়া বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অংশজুড়ে আছে ভারত। ভারত থেকে কী সুবিধা পাব, আর চীনের কাছ থেকে কী সুবিধা পাব—এটা আমাদের ঠিক করতে হবে। এই দুই দেশ আমাদের কী দিচ্ছে, আমরা কীভাবে তাদের সঙ্গে দর–কষাকষি করতে পারি, সেটা ঠিক করা জরুরি।’

ভারত সক্রিয়ভাবে বিআরআইতে যুক্ত হলে তা বাংলাদেশ ও দক্ষিণ এশিয়ার জন্য ব্যাপক সুফল বয়ে আনবে বলে মনে করেন চীনে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত ও গবেষণাপ্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের (বিআইআইএসএস) পরিচালনা পরিষদের সভাপতি মুন্সি ফয়েজ আহমেদ। তিনি বলেন, যদি ভারত এতে যুক্ত না হয়, তাতে অনেক ধরনের বাধা তৈরি হবে।

যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত ও গবেষণাপ্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের (বিইআই) ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট এম হুমায়ূন কবীর বলেন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, আসিয়ান—চিরাচরিতভাবে এরা যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগী হিসেবে পরিচিত। চীনের সঙ্গে এদের সবার অর্থনৈতিক সম্পর্ক শক্তিশালী হচ্ছে। যদিও এদের নিরাপত্তা সহযোগিতা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে। তারা অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তা স্বার্থের ক্ষেত্রে ভারসাম্য আনছে। তাদের কাছ থেকে শিক্ষা নেওয়া যেতে পারে।

ভারতে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত তারিক এ করিম বলেন, ভূরাজনৈতিকভাবে বাংলাদেশের যে অবস্থান, তাতে দুই বৃহৎ শক্তির সঙ্গে ভারসাম্য রেখে চলতে হচ্ছে। প্রতিটি দেশের স্বার্থ রেখেই কিন্তু বন্ধুত্ব এগিয়ে নিতে হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এক দেশের সঙ্গে অন্য দেশের সম্পর্ক লেনদেনের ভিত্তিতে চলতে থাকে।

রোহিঙ্গা সমস্যার প্রসঙ্গ টেনে দ্য ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহ্ফুজ আনাম বলেন, ভারত ও চীন তাদের জাতীয় স্বার্থই দেখেছে। এটাই স্বাভাবিক। বাংলাদেশ তাদের যেভাবে চেয়েছে, সেভাবে পায়নি।

সময় আসবে, যখন ভারত ও চীন একে অন্যকে সহায়তা করবে বলে মনে করেন সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসান চৌধুরী। বিশেষ অতিথির বক্তৃতায় তিনি বলেন, ‘রোহিঙ্গা সমস্যার ব্যাপারে ভারত ও চীনের ভূমিকায় আমরা মোটেই সন্তুষ্ট নই। তাদের কাছে আমাদের অনেক বেশি প্রত্যাশা ছিল।’

আলোচনার সঞ্চালক সিপিডির বিশেষ ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, নীতি ও আদর্শের পন্থা অনুসরণে বহুপক্ষীয় ব্যবস্থা মেনে চলা, আঞ্চলিক ও অঞ্চলের বাইরের শক্তিকে কাজে লাগানো এবং নিজের সুযোগের সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহারে বাংলাদেশকে মনোযোগী হতে হবে। এ ব্যাপারে বৈশ্বিক, আঞ্চলিক ও জাতীয় এই তিন স্তরেই বাংলাদেশকে কাজ করতে হবে।

আলোচনায় আরও অংশ নেন চীনের ইউনান একাডেমি অফ সোশ্যাল সায়েন্সেসের ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজের সহযোগী অধ্যাপক গুয়ো সুইয়ান ও সহযোগী অধ্যাপক লিন ইয়ানমিং এবং নেপালের গবেষণা প্রতিষ্ঠান নেপাল-বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ ফোরামের প্রেসিডেন্ট কল্যাণ রাজ শর্মা।