জাপাকে হাতে রেখেই এগোতে চায় সরকার

রংপুর-৩ সংসদীয় আসনের উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী ঘোষণা করেছে। এইচ এম এরশাদের দল জাতীয় পার্টির (জাপা) প্রার্থীও ঠিক। এরই মধ্যে রংপুরে গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়েছে যে দল দুটিতে নির্বাচনী সমঝোতা হতে যাচ্ছে। এরই অংশ হিসেবে জাপার ভাঙন থামানো হয়েছে।

এদিকে শনিবার মধ্যরাত পর্যন্ত বৈঠক করে জাপার দুই পক্ষ সমঝোতায় পৌঁছেছে যে জি এম কাদের দলের চেয়ারম্যান থাকবেন আর রওশন এরশাদ সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা হবেন। রংপুরের উপনির্বাচনে দলের প্রার্থী করা হবে রওশনপুত্র সাদ এরশাদকে। এই সমঝোতার পেছনে সরকারের উচ্চ মহলের ভূমিকা ছিল বলে মনে করছেন জাপার অধিকাংশ নেতা-কর্মী।

দলটির দায়িত্বশীল নেতারা বলছেন, এই সমঝোতায় নানা রাজনৈতিক ইঙ্গিত আছে। প্রথমত, সরকার চাইছে না এখনই জাপা বিভক্ত হোক। কারণ, এখন পর্যন্ত দলটি আওয়ামী লীগের একমাত্র কার্যকর মিত্রশক্তি। তাই দলটিকে হাতে রেখেই সামনে এগোতে চায় সরকার। দ্বিতীয়ত, দলের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ও কর্তৃত্ব জি এম কাদের বা রওশন এরশাদ কারও হাতে এককভাবে যাক, তা সরকারের উচ্চ মহল চায় না। তাই দলটির অভ্যন্তরীণ বিরোধ তুঙ্গে ওঠায় শেষ মুহূর্তে সমঝোতায় সরকারি মহল ভূমিকা রাখে। জাপার নেতাদের অনেকে মনে করছেন, এবারের সমঝোতায় আবারও প্রমাণিত হয়েছে যে সরকারের উচ্চ মহল রওশনের ওপর আস্থাশীল, যার কারণে যে সাদ এরশাদকে প্রার্থী করা নিয়ে রওশনের সঙ্গে জি এম কাদেরের মধ্যে দ্বন্দ্বের সূত্রপাত; এখন তাঁকেই প্রার্থী করার সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে।

জাপার সভাপতিমণ্ডলীর একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের হাত–পা বাঁধা। এর বিকল্প কিছু করার উপায় নেই।’ তাঁর মতে, অমত থাকা সত্ত্বেও ছাড় দিয়ে দলের ভাঙন রোধ ও চেয়ারম্যানের পদ রক্ষা করতে হয়েছে জি এম কাদেরকে।

এরই মধ্যে গতকাল রওশনকে সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা করার জন্য স্পিকারকে চিঠি দিয়েছেন জি এম কাদের।

সমঝোতার নেপথ্যে
জাপার শীর্ষ নেতৃত্বের এই আপসরফাকে দলের ভেতরে-বাইরের অনেকে রংপুর উপনির্বাচনে জাপার সঙ্গে আওয়ামী লীগের সমঝোতার ইঙ্গিত দেখছেন। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, শনিবার রাতে সমঝোতা বৈঠকে রওশন ও জি এম কাদের দুই পক্ষের চারজন করে আটজন নেতা উপস্থিত ছিলেন। সেখানে নবম ব্যক্তি হিসেবে ছিলেন দলের মহাসচিব মসিউর রহমান। ওই বৈঠক শুরুর কয়েক ঘণ্টা আগে মসিউর গণভবনে যান।

সমঝোতা বৈঠকে থাকা একাধিক নেতা জানান, বৈঠকে মসিউর রহমান বলেছেন, রওশন এরশাদকে বিরোধীদলীয় নেতা ও সাদকে প্রার্থী করতে সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে নির্দেশনা আছে। ম​সিউর রহমান গতকাল রোববার সকালে বনানীর কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘পরিবারের পিতা-মাতা যখন বিবাদে জড়ান, তখন সন্তানেরা বিপদে পড়েন। গত তিন দিনে আমি সর্বাত্মকœচেষ্টা করে সমঝোতায় আনতে সক্ষম হয়েছিল। বড় ধরনের ভাঙন থেকে জাপা রক্ষা পেয়েছে।’

জাতীয় পার্টির নেতাদের বড় একটি অংশ মনে করে, মসিউর রহমানের এই ভূমিকার পেছনে তাঁর স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্য আছে। তা হচ্ছে, রাজনীতির পথঘাট অচেনা সাদ এরশাদ জয়ী হলে তাঁকে যতটা নিয়ন্ত্রণ করা যাবে, অন্যদের বেলায় তা সম্ভব হবে না। তাছাড়া জাপার স্থানীয় প্রভাবশালী নেতাদের অনেকের সঙ্গে তাঁর বিরোধ আছে। দলীয় মনোনয়ন বাছাইয়ে যিনি এগিয়ে ছিলেন, সেই এস এম ইয়াসিরের সঙ্গে মসিউরের সম্পর্ক ভালো নয়। ইয়াসিরকে ঠেকাতে সাদের মনোনয়ন নিশ্চিত করতে মসিউর সরকারি মহলে যোগাযোগ করেন বলে জাপায় আলোচনা আছে।

জাপার রংপুর মহানগরের সাধারণ সম্পাদক এস এম ইয়াসির প্রথম আলোকে বলেন, ‘সাক্ষাৎকার দেওয়ার পর তারা আমাকে রংপুরে পাঠাল, বলল যাও তুমি কাজ শুরু করো। এখন শুনছি প্রার্থী ঘোষণা স্থগিত। তারা তো আমাকে বিপদে ফেলেছে।’ তিনি বলেন, ‘রাঙা ভাই (মসিউর রহমান) আমাকে সমর্থন দেবেন না, সাদকে দেবেন। ওনাদের ধারণা, ইভিএমে ভোটে সাদকে জিতিয়ে দেবেন সরকার।’ সাদ এরশাদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘মনোনয়ন পেয়ে আমি খুশি। নির্বাচনে জয়ী হলে আরও খুশি হব।’

কোচ যতক্ষণ খেলাবেন, ততক্ষণ খেলব
রংপুর উপনির্বাচিনে আওয়ামী লীগ থেকে রেজাউল করিম ও বিএনপি থেকে রিটা রহমানকে প্রার্থী ঘোষণা করা হয়। কিন্তু গতকাল রংপুর শহরে প্রার্থী নিয়ে আলোচনা যতটা না ছিল, তার বেশি ছিল জাপা ও আওয়ামী লীগের নির্বাচনী সমঝোতার গুঞ্জন। অবশ্য এ গুঞ্জনকে অপপ্রচার বলে মন্তব্য করেন আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী রেজাউল করিম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘এটা তো রাজনীতি। আমরা রাজনীতির খেলোয়াড়। আমাকে দিয়ে আমার কোচ যেখানে খেলাবেন এবং যতক্ষণ খেলাবেন, আমি ততক্ষণ খেলব। এই মুহূর্তে নির্দেশ হলো নৌকার বিজয় ছিনিয়ে আনা। এর জন্য যত পরিকল্পনা, পদ্ধতি, কর্মসূচি নেওয়া দরকার সবটাই করব।’