ভাসমান সবজি চাষে সমৃদ্ধি

ভাসমান বেডে চাষ করা হয়েছে বিভিন্ন ধরনের সবজি। গত বুধবারের ছবি। প্রথম আলো
ভাসমান বেডে চাষ করা হয়েছে বিভিন্ন ধরনের সবজি। গত বুধবারের ছবি। প্রথম আলো

বরিশালের উজিরপুরের প্রত্যন্ত এলাকা সাতলা বিল। এখানকার বাসিন্দারা বছরের প্রায় ছয় মাস পানিবন্দী থাকে। এক ফসলি জমির কারণে তাদের অভাব–অনটনের মধ্যে থাকতে হয়। তবে তাদের বিকল্প আয়ের পথ খুলে দিয়েছে ভাসমান সবজি চাষ। লাভজনক হওয়ায় সহস্রাধিক কৃষক এ পদ্ধতিতে সবজি চাষ করছেন। বর্তমানে এ উপজেলায় ১৫০ হেক্টর জলাশয়ে ভাসমান সবজি চাষ হচ্ছে।

সাতলার নয়াকান্দি, শিবপুর, রাজাপুর, উত্তর সাতলা, পটিবাড়ী গ্রামের কৃষকেরা ভাসমান সবজি চাষের সঙ্গে যুক্ত। স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, বরিশাল সদর, গৌরনদী, উজিরপুর, বানরীপাড়া, আগৈলঝাড়া, বাকেরগঞ্জ ও আশপাশের পাইকারি ব্যবসায়ীরা আগে যশোর থেকে সবজি আনতেন। বর্তমানে শীত মৌসুমে উজিরপুরের গুঠিয়া, জল্লা, বামরাইল, হারতায় উৎপাদিত সবজি দিয়ে চাহিদা পূরণ হয়। কিন্তু বর্ষা মৌসুমে একমাত্র সাতলার ভাসমান সবজিই ভরসা।

শুরুর কথা

সাতলা বিলে ভাসমান সবজি চাষ কবে কীভাবে শুরু হয়েছিল, নির্দিষ্ট করে কেউ কিছু বলতে পারেননি। সাতলা গ্রামের কৃষক ভরত মণ্ডল (৭০) বলেন, ‘ছোটবেলা থেকেই ভাসমান সবজি চাষ দেখে আসছি। আমাদের বাবা-দাদারা এইভাবে চাষ করতেন। তাঁদের কাছে শুনেছি, এখানে রমেন বাড়ৈ নামের এক লোক প্রথমে এই চাষ শুরু করেছিলেন।’

উজিরপুরের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম বলেন, ২০-২৫ বছর আগে এলাকায় সামান্য পরিমাণে ভাসমান সবজি চাষ হতো। ২০১০ সালের পরে ব্যাপকতা লাভ করে। পরে ‘ভাসমান বেডে সবজি ও মসলা চাষ গবেষণা সম্প্রসারণ ও জনপ্রিয়করণ’ প্রকল্পের মাধ্যমে কৃষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। এতে চাষির সংখ্যা বাড়ছে। বর্তমানে ১৫০ হেক্টরে ভাসমান সবজি চাষ হচ্ছে।

বেড তৈরি

পানির ওপরে লম্বালম্বিভাবে দুটি বাঁশ বা কলাগাছ ফেলে তার ওপর কচুরিপানার স্তূপ করা হয়। পরে স্তূপ শেওলা দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়। কেউ কেউ নারকেলের ছোবড়া ব্যবহার করেন। শেওলা পচে শুকিয়ে গেলে তার ওপর সামান্য মাটি ছিটিয়ে দিয়ে লালশাক, পালংশাক, পুঁইশাকের বীজ বপন করা হয়। আর ঢ্যাঁড়স, লাউ, শসা, শিম, লাফা, কাঁকরোল, মিষ্টিকুমার, বেগুন উৎপাদন করতে কচুরিপানার ধাপই যথেষ্ট। উঁচু করে কচুরিপানার ধাপ তৈরি করে রাখার পর পচে গেলে ৫-৭ দিন পরেই তার ওপরে সরাসরি বীজ বপন করা হয়। ভাসমান সবজি চাষের একেকটি বেড এক মৌসুমের জন্য করা হয়। সবজি চাষ শেষ হলে ওই পচা ধাপ বোরো চাষের আগে জমিতে জৈব সার হিসেবে ব্যবহার করেন। ২০ মিটার লম্বা ২ থেকে আড়াই মিটার প্রস্থ একটি বেড তৈরি করতে সাড়ে ৩ হাজার থেকে ৪ হাজার টাকা খরচ হয়। এক মৌসুমে একেক বেড থেকে ৯ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকার সবজি বিক্রি হয়।

দক্ষিণ সাতলার শুকচাঁদ বিশ্বাস (৪৮) বলেন, ‘এবার ১০টি বেডে সবজি চাষ করেছি। বেড তৈরি করতে খরচ হয়েছে ৩৫ হাজার টাকা। ৬০ হাজার টাকার সবজি বিক্রি করেছি। এখন ৭০-৮০ হাজার টাকার সবজি বিক্রি করতে পারব।’

সরেজমিন একদিন

গত বুধবার সরেজমিন দেখা যায়, সাতলা বিলের পানির ওপর ভাসমান বেডে শসা, কাঁকরোল, মিষ্টিকুমড়া, লাউ, বেগুন, লালশাক, পালংশাকসহ নানা প্রকার সবজির সমারোহ। বিলের পানি ছাড়াও এই পদ্ধতিতে বাড়ির পাশে জলাশয়ে সবজি চাষ করা হচ্ছে।

শিবপুর গ্রামের শুকলাল বাড়ৈ (৪৫) বলেন, এলাকার অধিকাংশ জমিতে এক ফসল হয়। বছরে প্রায় ৬ মাস পানিতে তলিয়ে থাকে। আগে অভাব–অনাটন লেগেই থাকত। পরে ভাসমান সবজি চাষ শুরু করেন।

শুকলাল বাড়ৈ আরও বলেন, ‘সপ্তাহে দুদিন বানারীপাড়ার বিশারকান্দি ও চৌমহনী হাটে সবজি নিয়ে বিক্রি করি। কখনো কখনো ব্যবসায়ীরা এসে বাড়ি থেকেই সবজি কিনে নিয়ে যান। বিষমুক্ত হওয়ায় প্রচুর চাহিদা রয়েছে এসব সবজির।’

একই গ্রামের আনোয়ার বাহাদুর বলেন, ‘এলাকার অনেককে ভাসমান পদ্ধতিতে সবজি চাষ করতে দেখে আমিও শুরু করি। এতে অল্প পুঁজিতে বেশি লাভ হয়। বর্ষার মৌসুমে মানুষের কষ্ট হয়। তবে সাতলা বিলের মানুষের জন্য তা আশীর্বাদ।’